মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অভিবাসীদের গ্রিন কার্ড ও ভিসা নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি, সেখানে বসবাসরত অনেক বৈধ অভিবাসীকে আটকের ঘটনা ঘটেছে, যা অভিবাসন আইন নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
বিশেষ করে, ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে এই ধরনের পদক্ষেপ আরও বেড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আসুন, বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করার অনুমতিপত্র (Green Card) অথবা ভিসা (Visa) থাকা সত্ত্বেও, সম্প্রতি বেশ কয়েকজন অভিবাসীকে আটক করা হয়েছে অথবা বিমানবন্দরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এদের মধ্যে রয়েছেন গ্রিন কার্ডধারী, শিক্ষার্থী ভিসাধারী এবং এমনকি ওয়ার্ক ভিসাধারীও।
উদাহরণস্বরূপ, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গ্রিন কার্ডধারী অ্যাক্টিভিস্ট, জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এবং ব্রাউন ইউনিভার্সিটির একজন কিডনি প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদিও বৈধ অভিবাসনকে সমর্থন করার কথা বলেছেন, তবে তার প্রশাসনের কিছু পদক্ষেপ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের নেওয়া কিছু পদক্ষেপ নজিরবিহীন।
তাদের মতে, সাধারণত অনুসরণ করা নিয়ম-কানুন এক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না, এবং অভিবাসন আইনকে ভিন্নভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী মাহমুদ খালিলকে অভিবাসন কর্তৃপক্ষ আটক করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এমন কিছু কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন যা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির জন্য হুমকি স্বরূপ হতে পারে।
যদিও খালিলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের স্বপক্ষে এখনো পর্যন্ত কোনো প্রমাণ পেশ করা হয়নি। একই ধরনের অভিযোগে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও একজন শিক্ষার্থীকে আটকের চেষ্টা করা হয়েছিল, তবে আদালত এর ওপর স্থগিতাদেশ দেন।
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, সরকার ঠিক কী ধরনের প্রমাণ দেখালে গ্রিন কার্ড অথবা ভিসা বাতিল করতে পারে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রিন কার্ড বা ভিসা বাতিল করতে হলে সরকারকে যথেষ্ট প্রমাণ দেখাতে হয়।
এই প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ হতে পারে। যেমন, মাহমুদ খালিলকে ৮ মার্চ আটক করা হয় এবং তিনি এখনো লুইiana-র একটি ICE ডিটেনশন সেন্টারে বন্দী রয়েছেন।
তার আইনজীবীরা বলছেন, এই আটক বেআইনি এবং তারা মামলাটি নিউ জার্সিতে সরানোর চেষ্টা করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত বা বিমানবন্দরে ভিসা হোল্ডারদের প্রবেশের অনুমতি নাও দেওয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের হাতে কোনো প্রমাণ নাও থাকতে পারে।
অন্যদিকে, গ্রিন কার্ডধারীদেরও আটক করা যেতে পারে, তবে তাদের আদালতে নিজেদের বক্তব্য পেশ করার সুযোগ থাকে। গ্রিন কার্ড বাতিলের চূড়ান্ত ক্ষমতা শুধুমাত্র একজন ইমিগ্রেশন বিচারকের হাতেই থাকে।
গ্রিন কার্ডধারীদের deport করার বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে, যেমন – ধর্ষণ, হত্যা বা মাদক পাচারের মতো গুরুতর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া। এছাড়া, অভিবাসন সংক্রান্ত কোনো জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেলেও গ্রিন কার্ড বাতিল হতে পারে।
মাহমুদ খালিলের ঘটনার দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখা যায়, তাকে আটকের পর তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, তিনি তার গ্রিন কার্ডের আবেদনে কিছু তথ্য গোপন করেছেন।
তিনি জাতিসংঘের ফিলিস্তিন শরণার্থী বিষয়ক সংস্থায় (UNRWA) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করার বিষয়টি উল্লেখ করেননি। খালিলের আটকের আগে, কিছু সংগঠন অভিযোগ করেছিল যে, ট্রাম্প প্রশাসন তার বাক-স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘন করেছে।
এছাড়াও, মাদক-সংক্রান্ত অপরাধের কারণেও deport করা হতে পারে। জার্মান প্রকৌশলী এবং গ্রিন কার্ডধারী ফ্যাবিয়ান শ্মিটকে মার্চ মাসের ৭ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার সময় আটক করা হয়।
তার বিরুদ্ধে ১০ বছর আগের মাদক ও মদ্যপান করে গাড়ি চালানোর অভিযোগ ছিল। একইরকমভাবে, মা ইয়াং নামের একজন গ্রিন কার্ডধারী, যিনি আট মাস বয়স থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছিলেন, তাকে মাদক পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে লাওসে ফেরত পাঠানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আইনে বলা হয়েছে, গ্রিন কার্ডধারীকে deport করার আগে সরকারের পক্ষ থেকে একটি ‘নোটিশ টু অ্যাপিয়ার’ পাঠাতে হয়। এই নোটিশে উল্লেখ করা হয়, কেন ওই ব্যক্তিকে deport করা হবে।
ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞ এবং কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্যালাইন কেলি-উইডমারের মতে, এই নোটিশ পাওয়ার পর একজন অভিবাসন আদালতের মামলা শুরু হয়। আদালতে, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে প্রমাণ করতে হয় যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে deport করা উচিত।
তাদের ‘ক্লিয়ার অ্যান্ড কনভিন্সিং এভিডেন্স’ বা সুস্পষ্ট প্রমাণ দিতে হয়।
সরকারের আইনজীবীদের দেওয়া প্রমাণ মামলার ধরনের ওপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ, তারা কোনো অপরাধের প্রমাণ হিসেবে অভিযুক্তের অপরাধের রেকর্ড দেখাতে পারে।
আবার, কেউ যদি প্রমাণ করেন যে তিনি নন-রেসিডেন্ট হিসেবে ট্যাক্স ফাইল করেছেন, তবে তার গ্রিন কার্ড বাতিলের সম্ভাবনা থাকে।
আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা টুরিস্ট, স্টুডেন্ট বা ওয়ার্ক ভিসাধারীদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য। যদি সরকার মনে করে যে তাদের deport করা উচিত, তাহলে তাদেরও ‘নোটিশ টু অ্যাপিয়ার’ দেওয়া হয়।
ভিসা হোল্ডারদের অপরাধ, জালিয়াতি, ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া অথবা অবৈধভাবে কাজ করার কারণে deport করা যেতে পারে। তাদেরও গ্রিন কার্ডধারীদের মতোই আইনি অধিকার দেওয়া হয় এবং সরকারের প্রমাণ করার দায়িত্ব থাকে।
অন্যদিকে, জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী, বাদর খান সুরিকে তার স্টুডেন্ট ভিসা থাকা সত্ত্বেও আটক করা হয়। তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, তার কার্যক্রম যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির জন্য হুমকি স্বরূপ।
বিমানবন্দরেও ভিসা হোল্ডারদের প্রবেশের অনুমতি নাও দেওয়া হতে পারে। কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন অফিসারদের এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।
অতীতে কোনো অপরাধের রেকর্ড থাকলে, ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে অথবা অবৈধভাবে কাজ করার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আসার প্রমাণ পাওয়া গেলে, তাদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।
ইমিগ্রেশন আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসন গ্রিন কার্ডধারী এবং ভিসা হোল্ডারদের deport করার ক্ষেত্রে আইন মেনে চলছে কিনা, তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। কেউ বলছেন, প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে, কারণ অভিযুক্তদের নোটিশ দেওয়া হচ্ছে এবং তাদের আদালতের শুনানির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
তবে, অনেকে মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসন এক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অভিবাসীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দ্বারা সুরক্ষিত। ইমিগ্রেশন এজেন্টরা আদালতের ওয়ারেন্ট ছাড়া কারো বাড়িতে প্রবেশ করতে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বা সেখানে যেতে ইচ্ছুক যে কোনো মানুষের জন্য এই বিষয়গুলো জানা অত্যন্ত জরুরি।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা