ভারতে অভিবাসন নীতি নিয়ে মোদী ও ট্রাম্পের মধ্যে কি কোনো মিল রয়েছে?
সাম্প্রতিক সময়ে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতীয় নাগরিকদের বিতাড়নের খবর শোনা যাচ্ছিল, তখন অনেকেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। বিশেষ করে যখন দেখা গেল, আমেরিকার সামরিক বিমানে শিকল পরিয়ে deport করা হচ্ছে ভারতীয়দের, তখন বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। এই ঘটনার পরে বিরোধী দলগুলি, বিশেষ করে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, প্রতিবাদস্বরূপ হাতকড়া পরে নয়াদিল্লির সংসদ ভবনের বাইরে বিক্ষোভ করেন। তাঁদের দাবি ছিল, প্রধানমন্ত্রী মোদী যেন এই বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলেন।
কিন্তু পরবর্তীতে, হোয়াইট হাউসে বৈঠকের সময় বিতাড়ন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, মোদী জানান, তাঁর বিজেপি সরকার “অবৈধ অভিবাসীদের ফিরিয়ে আনতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত”। তিনি আরও যোগ করেন, “ভারতের তরুণ, অসহায় ও দরিদ্র মানুষজন অভিবাসনের শিকার হচ্ছেন। তাঁরা বড় স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতির দ্বারা আকৃষ্ট হন। অনেককে কেন আনা হচ্ছে, সে সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণা নেই – মানব পাচার চক্রের মাধ্যমে তাঁদের আনা হয়।”
পর্যবেক্ষকদের মতে, জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তির জন্য পরিচিত মোদীর এই ধরনের নরম প্রতিক্রিয়া ছিল অপ্রত্যাশিত। অনেকের ধারণা, সম্ভবত বাণিজ্য সংক্রান্ত আলোচনা চলছিলো বলে তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মতো বিতর্কে জড়াতে চাননি। তবে, অভিবাসন নীতির প্রশ্নে মোদী ও ট্রাম্পের মধ্যে যে একটা মিল রয়েছে, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
উভয় নেতাই তাঁদের দেশের উন্নতির জন্য বড় বড় স্বপ্নের কথা বলেন। ভারতের ক্ষেত্রে, বিজেপি সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ঘোষণা প্রায়ই শোনা যায়। যদিও বর্তমানে ভারতের অর্থনীতি কিছুটা ধীর গতিতে চলছে, তবে একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হল—বৈষম্য। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটিতে, শীর্ষ ১ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে জাতীয় সম্পদের ৪০.১ শতাংশ। ২০২৪ সালের শেষ দিকে, ভারতে ১৯১ জন বিলিয়নেয়ার ছিলেন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরেই তৃতীয় স্থানে। একই সময়ে, বিশ্বে চরম দারিদ্র্যের যে বৃদ্ধি হয়েছে, তার ৭০ শতাংশ ছিল ভারতেই। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক (২৩৪ মিলিয়ন) মানুষ এখনো চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী, কাগজপত্রবিহীন ভারতীয় অভিবাসীরা এই কঠিন বাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি। তাঁদের সঠিক সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন হিসাব রয়েছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের মতে, ২০২২ সালের শেষে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৭ লক্ষ কাগজপত্রবিহীন ভারতীয় অভিবাসী ছিলেন, যা মেক্সিকান ও সালভাদরীয়দের পরেই তৃতীয় বৃহত্তম সংখ্যা। আবার, মার্কিন স্বরাষ্ট্র নিরাপত্তা বিভাগ (Department of Homeland Security) -এর অনুমান, এই সংখ্যাটা ২ লক্ষ ২০ হাজারের মতো।
এই বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি, হিন্দুত্ববাদী নেতৃত্বের অধীনে ভারতের উজ্জ্বল অর্থনৈতিক চিত্রটির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। সম্ভবত এ কারণেই “অবৈধ অভিবাসন” বিষয়ক আলোচনা দ্রুত ও শান্তভাবে শেষ করতে চান মোদী। তিনি চান না, অভিবাসীদের প্রতি আচরণের কারণে ট্রাম্পের সঙ্গে কোনো বিরোধ দেখা দিক, যা ভারতের উন্নতির ধারণায় ফাটল ধরাবে।
অন্যদিকে, ভারতেও ট্রাম্পের মতো অভিবাসন-বিরোধী ধারণা নতুন নয়। বিগত কয়েক বছর ধরে, ভারতীয় ডানপন্থীরা বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসন নিয়ে নিয়মিতভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। ২০১৬ সালে, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু দাবি করেছিলেন, “ভারতে প্রায় ২ কোটি অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী” রয়েছে। ২০১৮ সালে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, “ভারতে ৪০ লক্ষেরও বেশি কাগজপত্রবিহীন অভিবাসী” বসবাস করে। ২০২৩ সালেও, কট্টরপন্থী রাজনীতিবিদরা দাবি করেছেন, এই সংখ্যা প্রায় ৫ কোটির কাছাকাছি।
যদিও এই সংখ্যাগুলোর সমর্থনে তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
কিন্তু ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের জন্য, এই ধরনের দাবি একটি শক্তিশালী চিত্র তৈরি করে। তাঁদের মতে, প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসা মুসলিম অভিবাসীরা হিন্দু জাতির জন্য এক বিরাট হুমকি। বাংলাদেশের অভিবাসন নিয়ে ভিত্তিহীন অভিযোগগুলো, ডানপন্থী রাজনীতিবিদদের “বহিরাগত”-দের দোষারোপ করার সুযোগ করে দেয়। অমিত শাহ একবার বলেছিলেন, “তাঁরা (বাংলাদেশি অভিবাসীরা) সেই শস্য খাচ্ছে, যা গরিবদের পাওয়া উচিত।” তিনি কাগজপত্রবিহীন অভিবাসীদের “উইপোকা” এবং “অনুপ্রবেশকারী” হিসেবেও বর্ণনা করেছেন। এমনকি ২০১৯ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় শাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বিজেপি সরকার “অনুপ্রবেশকারীদের ধরে বঙ্গোপসাগরে ছুঁড়ে ফেলবে”।
এই ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগগুলো হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে হিন্দুদের জনসংখ্যার সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে যাওয়ার ভয় তৈরি করতে সাহায্য করে। দিল্লির বিজেপি ইউনিটের নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায় এক টিভি সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত দেন, হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা “বিপদের সম্মুখীন”। তিনি বলেন, ভারত একটি “হিন্দু রাষ্ট্র” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং “অবৈধ”, “রোহিঙ্গা” ও “ধর্মান্তরিত”-দের কারণে এই পরিচয় দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। একইভাবে, উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ও “অবৈধ অভিবাসন”-কে “জনসংখ্যার পরিবর্তন”-এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও বলেন, এই কারণে দেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে অতিরিক্ত চাপ পড়ছে, নাগরিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে এবং গণতন্ত্র দুর্বল হচ্ছে। তাঁর মতে, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে হিন্দু জাতিগত পরিচয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ভারতে ডানপন্থীদের মধ্যে প্রায়ই শোনা যায়, “অবৈধ অভিবাসন” মানেই অপরাধ। ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এস জয়শংকর লোকসভায় দেওয়া এক বক্তব্যে বলেন, “অবৈধ গতিবিধি ও অভিবাসনের সঙ্গে আরও অনেক অবৈধ কার্যকলাপ জড়িত।” যদিও এখানে জয়শংকর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ভারতীয় অভিবাসীদের কথা বলছিলেন, ভারতেও কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, একটি “সুসংগঠিত” অপরাধ চক্র রয়েছে, যা কাগজপত্রবিহীন অভিবাসীদের বসবাসের অনুমতি, কর্মসংস্থান, ভুয়া জন্ম সনদ এবং এমনকি ভোটাধিকার পেতে সাহায্য করে। এর ফলস্বরূপ, ট্রাম্পের মতো পুলিশি অভিযান ও বিতাড়ন প্রক্রিয়া চলছে, যার লক্ষ্য—বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।
প্রায়শই, এই ধরনের অভিযানে ভারতের বাংলাভাষী মুসলিম নাগরিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কয়েক বছর আগের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসার চেয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে যাওয়ার সংখ্যা বেশি। কিন্তু ডানপন্থীদের উত্থানের যুগে, এসবের কোনো গুরুত্ব নেই। ট্রাম্পের আমেরিকা হোক বা মোদীর ভারত—সবখানেই দেশের ভেতরের সমস্যার জন্য বহিরাগতদের দায়ী করা হয়।
এই মানসিকতাই ভারত ও আমেরিকায় অভিবাসন-বিরোধী ঢেউ তৈরি করে। ভারতে, এটি ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (Citizenship Amendment Act) মতো আইনি পদক্ষেপের ভিত্তি তৈরি করেছে, যা প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আসা মুসলিমদের ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়।
মোদী হয়তো হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের প্রধানমন্ত্রী, তবে তিনি কাগজপত্রবিহীন ভারতীয়দের রক্ষার জন্য ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে রাজি নন। অভিবাসনের প্রশ্নে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ট্রাম্পের মতোই। এমনকি ভারতীয় নাগরিক হলেও, কাগজপত্রবিহীন মানুষের প্রতি তাঁর কোনো সহানুভূতি নেই।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা