পাকিস্তানের একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা, যেখানে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা একটি যাত্রীবাহী ট্রেনে হামলা চালায় এবং কয়েক ঘণ্টা ধরে জিম্মি করে রাখে কয়েকশ’ যাত্রীকে। এই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন ট্রেনের সহকারী চালক সাদ ক্বামার।
গত ১১ই মার্চ, পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে পেশোয়ারগামী জাফর এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন লক্ষ্য করে হামলা চালায় বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। সকাল সাড়ে সাতটায় (বাংলাদেশ সময়) সাদ ক্বামার সাদা-নীল ইউনিফর্ম পরে বাড়ি থেকে বের হন।
অন্যান্য দিনের মতোই তিনি পাকিস্তান রেলওয়ের লোকোশেডে যান। সেখানে তিনি ডিউটি ফর্ম পূরণ করে, ১,৬০০ কিলোমিটার দূরের যাত্রাপথের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। ট্রেনের প্রধান চালক আমজাদ ইয়াসিন এবং আরও চার শতাধিক যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি যাত্রা শুরু করে।
কিন্তু সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছিলো না। বেলা ১টার দিকে (বাংলাদেশ সময়) বোলান গিরিপথের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্যে বিকট শব্দে ইঞ্জিন কেঁপে ওঠে। সাদ ক্বামার এবং চালক দুজনেই বুঝতে পারেন, তারা আক্রান্ত হয়েছেন।
এর আগে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতেও জাফর এক্সপ্রেসে বোমা হামলা হয়েছিল, যাতে ট্রেনের কয়েকটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আক্রমণের পর চালক জরুরি ব্রেক করেন। ততক্ষণে ট্রেনের গতি ছিল ঘণ্টায় প্রায় ৪০ কিলোমিটার।
এরপর শুরু হয় বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। সশস্ত্র বিদ্রোহীরা যাত্রীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় এবং তাদের আইডি কার্ড দেখে আলাদা করতে শুরু করে। এরপর শুরু হয় জিম্মিদশা।
সাদ ক্বামার দ্রুত বেতার যোগাযোগের মাধ্যমে কাছের একটি রেলওয়ে স্টেশনে হামলার খবর জানান। কিন্তু ইঞ্জিনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চালক ইঞ্জিন বন্ধ করে দেওয়ায়, তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় তারা পরিবার বা বন্ধুদের সাথেও কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি। পরের দিন, ১২ই মার্চ বিকাল সাড়ে চারটায় (বাংলাদেশ সময়) স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপের (এসএসজি) কমান্ডোরা ক্বামারকে উদ্ধার করে।
তিনিসহ আরও ১৩৫ জন যাত্রীকে কোয়েটায় নিয়ে যাওয়া হয়। এই পুরো সময়টা, অর্থাৎ প্রায় ২৮ ঘণ্টা, তিনি ছিলেন ট্রেনের ইঞ্জিনেই। রমজান মাস চলায় তিনি রোজা রাখছিলেন।
ক্বামার বলেন, “মা খাবার দিয়েছিলেন, কিন্তু সন্ধ্যায় এক চুমুক জল খেয়ে আমি রোজা ভাঙি। পরের দিন সকালে আরও এক চুমুক জল খেয়ে আবার রোজা রাখি। তখন শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছিলাম।
এদিকে, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়ায়, পাকিস্তানে দ্রুত গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, হামলাকারীরা চালক এবং সহকারী চালককে হত্যা করেছে।
ক্বামারের বাবা গোলাম সাবির, যিনি নিজেও ৪০ বছর ধরে রেলের চালক ছিলেন, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় এক বন্ধুর ফোন পান। বন্ধু তাকে সাদ ক্বামারের খবর জানতে চান।
খবর পাওয়ার পর গোলাম সাবির কোয়েটা রেলওয়ে কন্ট্রোল রুমে ছুটে যান। সেখানে প্রথমে নিশ্চিত কোনো খবর পাওয়া যায়নি। পরে খবর আসে, ক্বামার জীবিত আছেন।
খবরটি পাওয়ার পর অন্যান্য রেলকর্মীরা তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। পাকিস্তানে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে, অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম পরিবহনের জন্য রেল ব্যবস্থা চালু হয়েছিল।
আজও দেশটির সাধারণ মানুষের জন্য রেল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সুলভ একটি মাধ্যম। তবে প্রায়ই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ট্রেনকে বেছে নেয়। বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এর আগেও যাত্রী ট্রেনে হামলা চালিয়েছে।
১১ই মার্চের হামলার দায় স্বীকার করে বিএলএ। এটি ছিল পাকিস্তানে হওয়া সবচেয়ে মারাত্মক হামলাগুলোর একটি। ক্বামার জানান, রেলের চাকরিতে যোগদানের পাঁচ বছরের মধ্যে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হননি তিনি।
পরিবারের সদস্যরা তাকে চাকরি ছাড়তে বললেও, বাবার উৎসাহে তিনি কাজে ফিরে আসেন। ক্বামার বলেন, “সহকারী চালক বা চালক হিসেবে আমরা সবসময় যাত্রীদের নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করি।
কারণ আমরাই তো যাত্রী ট্রেনের নেতা, আমাদের ওপর নির্ভর করে শত শত জীবন।” ঘটনার পর, ২৮শে মার্চ থেকে বালুচিস্তানের সাথে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের রেল যোগাযোগ পুনরায় চালু হয়েছে।
আগামী ৩রা এপ্রিল সাদ ক্বামার আবার কাজে যোগ দেবেন। তিনি একই ট্রেনে, সেই পরিচিত সাদা-নীল পোশাকে ফিরবেন, যাত্রীদের নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা