আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা: ট্রাম্পের শুল্ক নীতির প্রতিক্রিয়া।
বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক বাজারে আবারও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে, কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতি কার্যকর হতে চলেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় অন্যান্য দেশগুলোও পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত সপ্তাহে শেয়ার বাজারে প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের পতন হয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারগুলোতে কোভিড-১৯ মহামারীর শুরুর দিকের মতো বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের এই শুল্ক নীতি বহাল থাকলে বাজার আরও অস্থির হতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) মন্দা দেখা দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বুধবার থেকে চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) উপর শুল্ক আরোপের কারণে বাজারে অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে। অনেক বিনিয়োগকারী এখনো আশা করছেন, এই শুল্ক হয়তো স্থগিত করা হবে অথবা এতে পরিবর্তন আনা হবে।
তবে বাণিজ্য উত্তেজনা বাড়লে তার ফল মারাত্মক হতে পারে, বিশেষ করে চীনের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কের প্রতিক্রিয়ায়।
মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক বলেছেন, ট্রাম্পের লক্ষ্য হলো বিশ্ব বাণিজ্যকে নতুনভাবে সাজানো। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেইর স্টারমার বলেছেন, তিনি শুল্কের প্রভাব থেকে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের রক্ষা করার চেষ্টা করবেন এবং আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে বিস্তারিত ঘোষণা করবেন।
ধারণা করা হচ্ছে, স্টারমার একটি অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পরিকল্পনা করছেন, যার মধ্যে কর বাড়ানোর বিষয়ে লেবার পার্টির দেওয়া প্রতিশ্রুতি পুনর্বিবেচনা করার সম্ভাবনা রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ট্রেজারি মন্ত্রী ড্যারেন জোনস বিবিসিকে বলেছেন, বিশ্বায়নের যুগ শেষ হয়ে এসেছে, যদিও যুক্তরাজ্য এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে আগ্রহী। ট্রাম্পের শুল্কের মধ্যে যুক্তরাজ্যের উপর আরোপিত ১০ শতাংশ শুল্ক সবচেয়ে কম।
তবে এর আগে থেকেই যুক্তরাজ্য থেকে আমদানি করা ইস্পাত এবং গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যার ফলে জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার তাদের যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য পাঠানো স্থগিত করেছে।
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন, শুল্কের অপ্রত্যাশিত ও কঠোর প্রকৃতির কারণে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে আরও খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। বার্কলেজের বিশ্লেষকরা বলছেন, চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে যুক্তরাজ্য ও ইইউ উভয়ই মন্দার ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
তারা উভয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে দিয়েছে, একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রেরও প্রবৃদ্ধি কমতে পারে।
ইউনি ক্রেডিট ব্যাংকের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এরিক এফ. নিয়েলসেন বলেছেন, এই অর্থনৈতিক বিধ্বংসী অস্ত্রের প্রভাব এখনো অনুমান করা কঠিন। তবে এর ফল খারাপ হবে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে।
এমনকি বিশ্বজুড়েও মন্দা দেখা দিতে পারে।
এদিকে, বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক ইতালির একটি রাজনৈতিক দলের বৈঠকে বলেছেন, তিনি ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল দেখতে চান। তবে বুধবার থেকে ইউরোপের ওপর ২০ শতাংশ এবং চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে।
ইউরোপীয় নেতারা ট্রাম্পের এই শুল্ক নীতির নিন্দা করেছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তার দেশের ব্যবসায়ীদের যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন দের লেয়েন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে ইইউ সম্ভবত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করতে পারে, যেমন কমলালেবুর রস, জিন্স এবং হার্লে-ডেভিডসন মোটরসাইকেল।
চীনের অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ জর্জ ম্যাগনার মতে, দীর্ঘমেয়াদে একটি বাণিজ্য চুক্তি এখনো সম্ভব। কারণ, ট্রাম্প এবং শি জিনপিং কেউই এখনই পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যযুদ্ধ চান না।
ট্রাম্প চান ভোটারদের দেখাতে যে শুল্ক আরোপ করে রাজস্ব আদায় করা এবং সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, যা আমেরিকার অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। অন্যদিকে, শি জিনপিং চান অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে, যা রপ্তানিতে বড় ধরনের আঘাত হানতে পারে।
তবে ম্যাগনার সতর্ক করে বলেছেন, চীন বিশ্ব সরবরাহ শৃঙ্খলে তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চেষ্টা করছে এবং ট্রাম্প সেই নিয়ন্ত্রণ দুর্বল করতে চাইছেন। এর ফলস্বরূপ বিশ্ব হয়তো ট্রাম্পকে শুল্কের মাধ্যমে অথবা চীনের কাছে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান হারানোর মাধ্যমে এর মূল্য দেবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতির এই অস্থিরতা বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা দেখা দিলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতেও তার প্রভাব পড়তে পারে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান