আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর কাছ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা পেতে যাচ্ছে দেশটির সরকার। মঙ্গলবার এই বিষয়ে একটি প্রাথমিক চুক্তিতে পৌঁছেছে আইএমএফ এবং আর্জেন্টিনা।
আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট জ্যাভিয়ের মেইলেই দেশটির পুরনো অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন, এই প্রেক্ষাপটে এই সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে, এই ঋণ প্যাকেজ এখনো আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। খুব শীঘ্রই বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
আইএমএফের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এই ঘোষণা আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট মেইলেইকে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। তিনি মুক্তবাজার অর্থনীতির ভিত্তিতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছেন এবং দেশটির টালমাটাল অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন।
এর আগে বামপন্থী সরকারগুলোর ঋণ নেওয়ার নীতি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, যার ফলস্বরূপ আর্জেন্টিনা বারবার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিবার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে দেশটি।
দক্ষিণ আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে আর্জেন্টিনার জন্য এই মুহূর্তে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের মুদ্রণ নীতির কড়াকড়ি এবং দুর্বল আর্জেন্টাইন পেসোকে টিকিয়ে রাখতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমছিল।
এমন পরিস্থিতিতে, যদি আইএমএফের ঋণ পাওয়া না যেত, তাহলে কঠোরভাবে নেওয়া অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলো ভেস্তে যাওয়ার এবং দেশটির বিশাল ঋণ পরিশোধ ও আমদানি বিল মেটানো কঠিন হয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল।
নতুন এই সহায়তা পেলে প্রেসিডেন্ট মেইলেই আর্জেন্টিনার বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ সহজ করতে পারবেন, যা বাজারের আস্থা অর্জনে সহায়ক হবে।
গত ছয় বছর ধরে মূলধনের ওপর বিধিনিষেধের কারণে বিনিয়োগ কমেছে, কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফা বিদেশে পাঠাতে পারেনি। একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের সঙ্গে পেসোর বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে সতর্কভাবে কাজ করছিল।
১৯৫৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা ২২ বার আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছে। দেশটির মোট ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ রয়েছে আইএমএফের কাছে।
এর আগে নেওয়া বেশিরভাগ ঋণই আইএমএফের পুরনো ঋণ পরিশোধে ব্যবহৃত হয়েছে, যে কারণে আর্জেন্টিনার জনগণের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি এক ধরনের অসন্তোষ রয়েছে। অনেকে মনে করেন, ২০০১ সালে দেশটির অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও ঋণ খেলাপের জন্য আইএমএফ দায়ী।
যদিও আইএমএফ সাধারণত তাদের প্রধান ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে চুক্তি করতে দ্বিধা বোধ করে, তবুও গত ১৬ মাসে তারা মেইলেইয়ের কঠোর অর্থনৈতিক নীতিকে প্রশংসা করেছে।
মেইলেই একজন সাবেক টিভি ব্যক্তিত্ব এবং নিজেকে ‘অ্যানার্কো-ক্যাপিটালিস্ট’ হিসেবে পরিচয় দেন। ক্ষমতায় আসার পর তিনি আর্জেন্টিনার বিশাল আমলাতন্ত্র হ্রাস করা, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি কমানো, আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য অর্থনীতি উন্মুক্ত করা এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
অতীতে আর্জেন্টিনার রাজনীতিবিদরা জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ এড়াতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া এড়িয়ে যেতেন। কিন্তু মেইলেই রাষ্ট্রের আকার ছোট করতে কয়েক হাজার সরকারি কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছেন, এক ডজনের বেশি মন্ত্রণালয় বিলুপ্ত করেছেন বা তাদের ক্ষমতা কমিয়েছেন, শিক্ষাখাতেও ব্যাপক কাটছাঁট করেছেন।
এছাড়া পেনশন খাতেও বরাদ্দ কমানো হয়েছে, সরকারি নির্মাণ প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, মূল্য নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হয়েছে এবং ভর্তুকি কমানো হয়েছে।
তবে, সমালোচকরা বলছেন, আর্জেন্টিনার অর্থনীতির উন্নতির ফলে দরিদ্র মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে পেনশন কমানোর কারণে বয়স্ক নাগরিকরা নিয়মিত বিক্ষোভ করছেন।
শ্রমিক ইউনিয়নগুলোও বুধবার থেকে ৩৬ ঘণ্টার সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।
অন্যদিকে, মেইলেই এখনো পর্যন্ত ভালো জনসমর্থন ধরে রেখেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তাঁর সাফল্যের কারণে এমনটা হয়েছে।
তাঁর দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম বছরে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি ২১ শতাংশ থেকে ১১৮ শতাংশে নেমে এসেছে। বাজেট ঘাটতি কমিয়ে উদ্বৃত্ত তৈরি করতে পারায় স্থানীয় শেয়ার বাজারেও দারুণ উন্নতি হয়েছে।
বিনিয়োগকারীদের আস্থার গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত দেশটির ঝুঁকি-সূচকও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
আইএমএফ এক বিবৃতিতে বলেছে, “সরকারের শক্তিশালী আর্থিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এর মাধ্যমে দ্রুত মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হয়েছে। এই কর্মসূচি আর্জেন্টিনার স্থিতিশীলতা ও সংস্কারের পরবর্তী পদক্ষেপকে সমর্থন করবে।”
তবে, আর্জেন্টিনার পক্ষ থেকে কত টাকা পাওয়া যাবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। সাম্প্রতিক আলোচনার এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল।
ঋণ বিতরণের বিষয়েও এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। সাধারণত, আইএমএফের ঋণ কয়েক বছরে বিতরণ করা হয়। কিন্তু আর্জেন্টিনা চাইছে অগ্রিম একটি বড় অংশ, যাতে রিজার্ভ বাড়ানো যায়।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে (X) আইএমএফের বিবৃতি শেয়ার করে মেইলেই অর্থনীতিমন্ত্রী লুইস ক্যাপুটোর সঙ্গে একটি ছবি যুক্ত করেন। তিনি লেখেন, “Vamos!” (আসুন!)।
তথ্য সূত্র: সিএনএন