প্রকৃতি যেন এক বিস্ময়কর ভাণ্ডার, যেখানে লুকিয়ে আছে কত অজানা রহস্য। সম্প্রতি, বিজ্ঞানীরা এমনই এক বিশেষ প্রাণীর সন্ধান পেয়েছেন, যা চিকিৎসা বিজ্ঞানে আনতে পারে যুগান্তকারী পরিবর্তন।
খবরটি হলো, আমেরিকার ‘বেরিয়িং বিটল’ বা সমাধিস্থ কীট নিয়ে, যা পচনশীল মাংস খেয়ে বাঁচে এবং কীটনাশকের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই পোকা নতুন প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সাধারণত, এই পোকা মাটির নিচে বাস করে। এদের জীবনযাত্রা বেশ আকর্ষণীয়। এরা মরা প্রাণী, যেমন ইঁদুর, পাখি এবং অন্যান্য ছোট আকারের জীবজন্তুর মাংস খায়।
খাবারের সন্ধানে এরা কয়েক মাইল পর্যন্ত উড়তে পারে। মৃতদেহ খুঁজে পাওয়ার পর, স্ত্রী ও পুরুষ পোকা মিলে সেটিকে মাটির নিচে নিয়ে যায়। এরপর তারা মৃতদেহ থেকে পশম বা পালক সরিয়ে, গোল করে তাদের শরীর থেকে নিঃসৃত রস দিয়ে ঢেকে দেয়।
এই প্রক্রিয়া মাংসকে অনেক দিন পর্যন্ত তাজা রাখে। এরপর স্ত্রী পোকা ডিম পাড়ে এবং পোকার বাচ্চাগুলোর দেখাশোনা করে, যা পোকাদের মধ্যে একটি বিরল দৃষ্টান্ত।
কিন্তু প্রকৃতির এই অসামান্য প্রাণীটি এখন হুমকির সম্মুখীন। আবাসস্থল ধ্বংস এবং পরিবেশ পরিবর্তনের কারণে এদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা তাই এদের বাঁচানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কীটনাশক, বিশেষ করে ‘নিওনিকোটিনয়েডস’-এর প্রভাব নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই কীটনাশক পোকাদের শরীরে প্রবেশ করলে তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, বরং সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।
কীটনাশকের প্রভাবে তারা স্বাভাবিক আচরণ হারিয়ে ফেলে, যা তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির কীটতত্ত্ববিদ ওয়ায়েট হব্যাক বলেন, “পোকাগুলো কীটনাশকের প্রভাবে প্রথমে দুর্বল হয়ে পড়ে, তারপর কিছুক্ষণ পর আবার সুস্থ হয়ে ওঠে। অন্যান্য পোকার ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায় না।” বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই পোকাদের শরীরে এমন কিছু বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে, যা তাদের কীটনাশকের বিষক্রিয়া থেকে বাঁচায়।
গবেষকরা আরও বলছেন, এই পোকাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধের অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে। সম্ভবত, পচনশীল মাংস খাওয়ার কারণে তাদের শরীরে এমন কিছু উপাদান তৈরি হয়, যা তাদের বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করে। বিজ্ঞানীরা এখন এই পোকার জিন এবং শরীরের অভ্যন্তরে থাকা অণুজীব নিয়ে গবেষণা করছেন।
তাদের লক্ষ্য হলো, এই পোকার শরীর থেকে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া খুঁজে বের করা, যা অ্যান্টিবায়োটিক তৈরিতে কাজে লাগবে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই আবিষ্কার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। বিশেষ করে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া, যেমন ‘এমআরএসএ’ (MRSA) বা মেথিসিলিন-প্রতিরোধী স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এই ব্যাকটেরিয়া মানুষের শরীরে মারাত্মক সংক্রমণ ঘটায়। বিজ্ঞানীরা যদি বেরিয়িং বিটলের রোগ প্রতিরোধের কৌশল কাজে লাগাতে পারেন, তাহলে হয়তো এমন ওষুধ তৈরি করা সম্ভব হবে, যা এমআরএসএ-এর মতো কঠিন রোগের চিকিৎসায় সাহায্য করবে।
নিউ মেক্সিকো স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. ইমো হ্যানসেনের মতে, এই পোকা এবং তাদের শরীরে থাকা অণুজীবগুলি অ্যান্টিবায়োটিকের পরবর্তী প্রজন্মের চাবিকাঠি হতে পারে। তিনি আরও বলেন, “তাদের অবশ্যই এমন কিছু অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা মানুষের ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।”
বেরিয়িং বিটলের এই অসাধারণ ক্ষমতা মানুষের স্বাস্থ্যখাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। বিজ্ঞানীরা এখন এর জিনগত গঠন এবং শরীরের অভ্যন্তরে থাকা ব্যাকটেরিয়া নিয়ে আরও গভীর গবেষণা করছেন। তাদের আশা, এই গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য নতুন ওষুধ তৈরিতে সাহায্য করবে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক