লেবানন এবং সিরিয়ায় প্রতিবেশী দেশগুলোকে দুর্বল করে রাখার কৌশল এখনো অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল, এমনটাই বলছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ লেবানন ও সিরিয়ার স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করছে।
বিশেষজ্ঞ, বিশ্লেষক এবং কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইসরায়েল চাইছে এই দুটি দেশকে দুর্বল এবং বিভক্ত রাখতে, যাতে তারা আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারে। “ইসরায়েলিরা মনে করে, দুর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র তাদের জন্য সুবিধাজনক। কারণ সেক্ষেত্রে তারাই হয় সবচেয়ে শক্তিশালী পক্ষ,” মন্তব্য করেন ‘দ্য ফায়ার দিস টাইমস’ পডকাস্টের প্রতিষ্ঠাতা এলিয়া আইয়ুব।
সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে ইসরায়েলের তুলনায় দুর্বল হওয়ায় লেবানন ও সিরিয়া সাধারণত তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পারে না। বর্তমানে উভয় দেশই সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।
লেবানন দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক দুরবস্থায় রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা লেগেই আছে সেখানে। সম্প্রতি ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদী হামলায় ৪ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। ১৯৮০-এর দশক থেকে লেবাননের রাজনীতিতে প্রভাবশালী একটি শক্তি হিজবুল্লাহও এই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ২৭শে নভেম্বরের যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে এই পরিস্থিতির অবসান হয়।
অন্যদিকে, সিরিয়া প্রায় ১৪ বছর ধরে চলা এক দীর্ঘ যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এই যুদ্ধে কয়েক মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং কয়েক লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছে। দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করা, অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, লেবাননের মতো সিরিয়াও সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু ইসরায়েল সম্ভবত চাইছে, কোনোভাবেই যেন তারা ঘুরে দাঁড়াতে না পারে।
যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল নিয়মিতভাবে তা লঙ্ঘন করছে। তারা প্রতিটি লঙ্ঘনের কারণ হিসেবে হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর দাবি করে। লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। যুদ্ধের সময় কিছু গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে এবং যুদ্ধবিরতির পরও ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লেবাননের সিভিল ডিফেন্সের এক সদস্য জানান, “এখানে অনেকবার চুক্তি লঙ্ঘন হয়েছে। আমাদের কিছু করার নেই।”
ইসরায়েল এখনো লেবানন থেকে সম্পূর্ণরূপে সেনা প্রত্যাহার করেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্ত চিহ্নিত করার বিষয়ে ভবিষ্যৎ আলোচনার জন্য তারা কৌশলগতভাবে পাঁচটি স্থানে সেনা মোতায়েন রেখেছে। কার্নেগি মিডল ইস্ট সেন্টারের সিনিয়র ফেলো মোহানাদ হage আলী বলেন, “লেবাননের অভ্যন্তরে ইসরায়েলের অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে কোনো সীমা নেই। শুধু ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে হামলার প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষেত্রে তারা ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা নির্ধারণ করে।”
২০১৮ সালের ৮ই ডিসেম্বরের পর বাশার আল-আসাদের শাসনের পতনের পর সিরিয়ায়ও সামরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। মূলত দক্ষিণাঞ্চলে তারা তাদের কার্যক্রম জোরদার করেছে এবং সিরিয়ার ভূখণ্ডে আরও গভীরে প্রবেশ করেছে।
সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আঞ্চলিক যুদ্ধ চায় না এবং ইসরায়েলের ওপর হামলার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই বলে জানিয়েছে। তারা ১৯৭৪ সালের ‘ডিসএনগেজমেন্ট চুক্তি’ মেনে চলারও ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু সিরিয়ার এই আহ্বান কানে নেয়নি ইসরায়েল। দেশটির সরকার নতুন সিরীয় সরকারকে ‘ইদলিব থেকে আসা একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ হিসেবে অভিহিত করেছে, যারা জোর করে দামেস্ক দখল করেছে। এরপর থেকে ইসরায়েল সিরিয়ার ওপর বোমা হামলা অব্যাহত রেখেছে এবং গোলান মালভূমি ও সিরিয়ার মধ্যে সীমান্ত অঞ্চলে নিজেদের ভূখণ্ড বিস্তার করেছে।
সেন্টুরি ইন্টারন্যাশনালের ফেলো আরন লান্ড বলেন, “ইসরায়েল বাজি ধরেছে যে সিরিয়া ব্যর্থ হবে এবং খন্ড-বিখন্ড হয়ে যাবে। তারা এমন একটি পরিস্থিতিতে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে চাইছে, যাতে দক্ষিণাঞ্চলে তাদের প্রভাব থাকে এবং তাদের জন্য কোনো হুমকি তৈরি না হয়। একইসঙ্গে তারা তাদের আকাশ সীমায় অবাধ স্বাধীনতা বজায় রাখতে চায়।”
মার্চ মাসে সিরিয়ার ওপর ইসরায়েলের বিমান হামলা বৃদ্ধি পায় এবং নতুন নতুন এলাকায় তা বিস্তৃত হয়। এমনকি স্থল অভিযানও ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে তারা দেরার দক্ষিণ এলাকা এবং আল-কুনাইত্রাতেও প্রবেশ করে।
এসিএলইডি-এর মধ্যপ্রাচ্য গবেষণা ব্যবস্থাপক মুয়াজ আল-আব্দুল্লাহ এক বিবৃতিতে বলেন, “নাগরিকদের ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।” দেরার কুয়া গ্রামের বাসিন্দারা ইসরায়েলি বাহিনীকে গ্রামটিতে প্রবেশ করতে বাধা দিতে সতর্কতামূলক গুলি চালায়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি বাহিনী বিমান হামলা চালায় এবং গ্রামটিতে গোলাবর্ষণ করে, যাতে অন্তত ছয়জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। দেরার বাসিন্দা ইমাদ আল-বায়সিরি জানান, নাওয়া শহরেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, লেবানন ও সিরিয়ার ওপর ইসরায়েলের এই হামলা বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, “তারা আমেরিকানদের কথা শোনে, তবে সীমিত আকারে।” হিজবুল্লাহর অস্ত্রশস্ত্র একসময় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক যুদ্ধে সেই হিসাব পাল্টে গেছে।
কার্নেগি মিডল ইস্ট সেন্টারের সিনিয়র ফেলো মোহানাদ হage আলী বলেন, “সমস্ত প্রতিরোধ ক্ষমতা এখন দুর্বল হয়ে গেছে।”
লেবানন ও সিরিয়ার অগ্রগতি ব্যাহত করতে এবং তাদের বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিমজ্জিত রাখতে ইসরায়েল সম্ভবত কোনো কূটনৈতিক বা সামরিক চাপের তোয়াক্কা করছে না। এলিয়া আইয়ুব বলেন, “ইসরায়েল এই অঞ্চলে তাদের সেরা পরিস্থিতি হিসেবে এমনটাই দেখে। এটি ইসরায়েলি রাজনীতির গভীর হতাশা এবং দশকের পর দশক ধরে চলা সামরিকবাদের প্রতিফলন, যা দেশটির রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অংশে পরিণত হয়েছে।”
আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ বৈরুতে ৮ই এপ্রিল এক বক্তৃতায় সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্য প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো নাতাশা হল বলেন, অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ইসরায়েল এই অঞ্চলে একটি ‘চিরস্থায়ী যুদ্ধ’ চায়, যেখানে তারা ‘স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে’।
অন্যদিকে, কূটনীতিক সূত্রটি আল জাজিরাকে বলেছে: “এই [ইসরায়েলি] সরকার জানে কীভাবে যুদ্ধ করতে হয়। তবে তারা এখনো দেখায়নি কিভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হয়।”
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা