শিরোনাম: ডেমোক্র্যাট শিবিরে নতুন প্রাণ, ট্রাম্প বিরোধী আন্দোলনে বার্নি স্যান্ডার্সের উত্থান
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, যখন ডেমোক্রেটিক পার্টি হতাশ কর্মীদের উজ্জীবিত করতে এবং ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা বিস্তারের মোকাবিলায় ব্যস্ত, সেই সময়ে বার্নি স্যান্ডার্স প্রতিরোধের এক প্রধান কন্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
খবর অনুযায়ী, এই বামপন্থী রাজনীতিকের পরিচিত বার্তা এখন নতুন করে আলোচনা সৃষ্টি করেছে।
বার্মন্টের এই স্বতন্ত্র সিনেটর ডেমোক্র্যাটদের কাছে অপরিচিত নন, কারণ তিনি দুবার দলের প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
তবে এমন এক মুহূর্তে যখন ডেমোক্রেটিক সমর্থকরা ট্রাম্প প্রশাসনের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আরও জোরালো প্রতিরোধ দাবি করছেন, তখন ২০১৬ ও ২০২০ সালের নির্বাচনে স্যান্ডার্সের প্রচারণার মূল চালিকাশক্তি নতুন রাজনৈতিক জীবন লাভ করেছে।
ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাবমূর্তি যখন দুর্বল, তখন প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম পরিচিত মুখ স্যান্ডার্স, তার পুরোনো ‘বিলিয়নেয়ার শ্রেণি’র বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা নিয়ে দেশজুড়ে সমাবেশে হাজার হাজার সমর্থককে আকৃষ্ট করেছেন।
সম্প্রতি নিউইয়র্কের কংগ্রেসম্যান অ্যালেক্সান্ড্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজও তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।
তারা উভয়েই ট্রাম্প, তার প্রশাসন এবং বর্তমান সরকারের অধীনে কর্তৃত্ববাদের উত্থানের প্রতিবাদ করেছেন।
স্যান্ডার্সের ‘ফাইটং অলিগার্কি’ নামে পরিচিত সফরটি ক্যালিফোর্নিয়া, উটাহ এবং আইডাহোতে অনুষ্ঠিত হবে।
ওয়াশিংটনের ডেমোক্র্যাটরা যখন ট্রাম্প প্রশাসন এবং রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধে তাদের সমর্থকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক তখনই এই সফর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
গত মাসে ট্রাম্পের কংগ্রেসে দেওয়া ভাষণের সময় ডেমোক্র্যাটদের সামাজিক মাধ্যম প্রচারণা এবং প্রতিবাদ তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি।
এমনকি, সিনেটের সংখ্যালঘু নেতা চাক শুমারের পদত্যাগের দাবিও উঠেছে, কারণ তিনি রিপাবলিকানদের অর্থ বিল পাসে সহায়তা করেছিলেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ডেমোক্র্যাট না হয়েও, নিজেকে ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী’ হিসেবে পরিচিত স্যান্ডার্সের ট্রাম্প-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া, ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাবমূর্তির দুর্বলতাকেই তুলে ধরে।
গত মাসে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, তার সফরের অন্যতম লক্ষ্য হলো, মানুষকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে উৎসাহিত করা।
স্যান্ডার্সের সমাবেশগুলো ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের সময়কার ডেমোক্রেটিক ‘প্রতিরোধের’ পুনরুত্থানের সঙ্গে মিলে গেছে।
উইসকনসিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্য সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা জয়লাভ করেছে এবং ফ্লোরিডার দুটি বিশেষ নির্বাচনে রিপাবলিকানদের ব্যবধানও কমেছে।
উভয় দলের সদস্যদের টাউন হলগুলোতে ক্ষুব্ধ ভোটাররা আইনপ্রণেতাদের প্রেসিডেন্টের ওপর নজর রাখার দাবি জানিয়েছেন।
গত সপ্তাহে দেশজুড়ে ১,৪০০ ‘হ্যান্ডস অফ!’ সমাবেশে ট্রাম্প, এলন মাস্ক এবং ডগ-এর (DOGE) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ৬ লক্ষাধিক মানুষ অংশ নিয়েছিল।
গ্রাসরুট সংগঠন ‘ইনডিভিজিবল’-এর সহ-নির্বাহী পরিচালক এজরা লেভিন বলেছেন, স্যান্ডার্সের সমাবেশের কৌশল ট্রাম্প প্রশাসনের এজেন্ডা এবং জাতীয় পর্যায়ে ডেমোক্রেটিক নেতৃত্বের অভাবের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের ক্ষোভের প্রতিক্রিয়া হিসেবে কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে তৃণমূল পর্যায়ে এক নতুন উদ্যম সৃষ্টি হয়েছে।
মানুষ নেতৃত্ব চাইছে এবং এর পাশে দাঁড়াতে আগ্রহী।
স্যান্ডার্সের এই পদক্ষেপ কিছু ডেমোক্রেটকে অনুপ্রাণিত করলেও অন্যদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেছে।
মিনেসোটার গভর্নর টিম ওয়ালজ এবং অন্যান্য ডেমোক্রেটিক নেতারাও হাউস রিপাবলিকানদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে টাউন হলের আয়োজন করেছেন।
তবে, থার্ড ওয়ে-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ম্যাট বেনেট মনে করেন, স্যান্ডার্সের সমাবেশ তার সমর্থকদের কাছে জনপ্রিয় হলেও, এটি সেইসব ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না, যাদের ডেমোক্র্যাটদের পুনরায় জেতা প্রয়োজন।
বিশেষ করে, যারা ২০২০ সালে জো বাইডেনকে ভোট দিয়েছিলেন, কিন্তু ২০২৪ সালে ট্রাম্পকে সমর্থন করেছেন।
বেনেটের মতে, “স্যান্ডার্স সবসময় ধনী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কথা বলেন।
তবে শ্রমিকশ্রেণী আসলে এটা চায় না।
তারা এলন মাস্কের ওপর রেগে নেই, বরং তারা ক্ষুব্ধ কারণ তিনি এমন কিছু জিনিস ধ্বংস করছেন যা তারা চায় না।
বামপন্থী শিবিরে স্যান্ডার্স একা নন।
ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে, ইলিনয়ের জেবি প্রিটজকার নিজেকে ট্রাম্পের প্রধান সমালোচকদের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ক্যালিফোর্নিয়ার গ্যাভিন নিউসাম এবং কেনটাকির অ্যান্ডি বেশিয়ার মতো ডেমোক্রেটিক গভর্নররা তাদের দলের ভাবমূর্তি পরিবর্তনের জন্য পডকাস্ট শুরু করেছেন।
নিউ জার্সির সিনেটর কোরি বুকারও সম্প্রতি একটি ঐতিহাসিক বক্তৃতার মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি লাভ করেছেন।
দীর্ঘদিন ধরে স্যান্ডার্স সতর্ক করে আসছেন যে, অতিরিক্ত সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু আমেরিকানের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে এবং দেশ ‘বিলিয়নেয়ার শ্রেণি’ দ্বারা শাসিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
মাস্ক যখন সরকারের আকার কমানোর চেষ্টা করছেন, তখন তার সমর্থকদের মধ্যে অলিগার্কি বা ধনতন্ত্রের ধারণাটি নতুন গুরুত্ব পেয়েছে।
স্যান্ডার্সের উপদেষ্টা ফাইজ শাকির বলেন, “হয়তো অনেকেই অলিগার্কির একাডেমিক সংজ্ঞা দিতে পারবে না, তবে তারা জানে এটা খারাপ, এটি হলো ধনীদের শাসন এবং এটি ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্কিত।
শাকির স্যান্ডার্সের সমাবেশের জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে শ্রেণী বিভাজনের ওপর তার মনোযোগকে উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেন, “উপরের শ্রেণী বনাম নিচের শ্রেণীর এই দৃষ্টিকোণই ব্যাখ্যা করে কেন বার্নি একটি বিশেষ ব্র্যান্ড হিসেবে এই লড়াইগুলোর সঙ্গে বেশি জড়িত।
ডেমোক্রেটিক পার্টি সেভাবে জড়িত নয়।
বর্তমানে, ডেমোক্রেটিক পার্টির অভ্যন্তরীণ বিতর্ক হলো, তারা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কতটা আগ্রাসী হবে।
স্যান্ডার্সের সফরটি একটি পুরনো বিতর্কের জন্ম দিয়েছে: প্রগতিশীল বার্তাগুলো কি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী এলাকাগুলোতে প্রভাব ফেলে?
স্যান্ডার্সের সফরের কয়েকটি স্থান রিপাবলিকানদের দখলে থাকা আসনগুলোর দিকে দৃষ্টি দিয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে কলোরাডোর গ্রেলেতে অনুষ্ঠিত সমাবেশ, যা প্রতিনিধি গেব ইভান্সের জেলার অন্তর্ভুক্ত এবং উইসকনসিনের আলটোনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশ, যা ডেরেক ভ্যান অর্ডেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।
সফরের প্রথম গন্তব্য ছিল নেব্রাস্কার ২য় কংগ্রেসনাল জেলা, যেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির উভয় পক্ষ দীর্ঘদিন ধরে পাঁচবারের প্রতিনিধি ডন বেকনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।
২০১৬ সালে বেকন মধ্যপন্থী ডেমোক্রেট ব্র্যাড অ্যাশফোর্ডকে পরাজিত করার পর, দলের সমর্থন ছিল অ্যাশফোর্ডের প্রতি।
তবে তিনি ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে কার ইস্টম্যানের কাছে হেরে যান।
ইস্টম্যান একক-বেতন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে প্রচারণা চালিয়েছিলেন।
ইস্টম্যান সাধারণ নির্বাচনে হেরে যান এবং ২০২০ সালের নির্বাচনেও তিনি টিকতে পারেননি।
বেকন ডেমোক্র্যাট টনি ভার্গাসের কাছ থেকেও দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন।
ফেব্রুয়ারিতে স্যান্ডার্সের সফরের আগে বেকন এক্সে (X) লিখেছিলেন, “আমরা সবসময় বার্নি স্যান্ডার্সকে নেব্রাস্কায় স্বাগত জানাই।
তিনি আমাদের ডেমোক্রেটিক সমাজতন্ত্রের খারাপ দিক এবং আমরা যে মহান রাজ্যে বাস করি, তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকতে উৎসাহিত করেন।
নেব্রাস্কা ডেমোক্রেটিক পার্টির নির্বাহী পরিচালক প্রেসিয়াস ম্যাককেসন বলেছেন, এপ্রিলের শেষ নাগাদ রাজ্যের ডেমোক্র্যাটরা পাঁচটি টাউন হলের আয়োজন করবে, যেখানে স্যান্ডার্স, ওয়ালজ এবং ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্রেটিক প্রতিনিধি রো খান্নাও অংশ নেবেন।
তিনি বলেন, “আমরা ভোটারদের কথা শোনার এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কথা তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
৮০ বছর বয়সী ভিয়েতনাম যুদ্ধের অভিজ্ঞ উইলিয়াম কক্স গত মাসে টুসোনে স্যান্ডার্স এবং ওকাসিও-কর্তেজের সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন।
তিনি মনে করেন, আমেরিকানদের আরও বেশি বিক্ষোভে অংশ নেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, “যদি পরিস্থিতি এমনই চলতে থাকে, তবে সবার রাস্তায় নামা উচিত।
আমি আমার স্ত্রীকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে হলেও রাস্তায় নামব।
মানুষকে জানাতে হবে যে, আপনি মনে করেন যা ঘটছে তা ভুল এবং আমেরিকান মূল্যবোধের পরিপন্থী।
উটাহর সেন্ট জর্জের ২৭ বছর বয়সী স্যান্ডার্স সমর্থক ব্রায়ানা রাসমুসেন গত মাসে তার বাগদত্তার সঙ্গে লাস ভেগাসে একটি সমাবেশে যোগ দিতে ১৯৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিলেন।
তিনি নারী অধিকার ও গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন।
সেইসঙ্গে তার ঠাকুমার ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে স্বাস্থ্য বীমার ওপর নির্ভরশীলতা নিয়েও তিনি চিন্তিত ছিলেন।
তার মা, যিনি সম্প্রতি স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন, শেয়ার বাজারের খারাপ অবস্থার কারণে চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য তার সঞ্চিত অর্থ ব্যবহার করতে উদ্বিগ্ন।
ব্রায়ানা বলেন, “আমি যখন সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার কথা শুনি, তখন ভালো লাগে, কারণ চিকিৎসার সময় বিল নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, শুধু কেমোথেরাপির দিকে মনোযোগ দেওয়া যাবে।
রাসমুসেন বলেন, স্যান্ডার্স এবং ওকাসিও-কর্তেজ কয়েকজন রাজনীতিবিদের মধ্যে অন্যতম, যাদের কাছ থেকে মানুষ কথা শুনতে পাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, “আমি হতাশ, তবে মনে করি তারা অন্তত কিছু করছেন।
তারা সবকিছুতে মনোযোগ আকর্ষণ করছেন।
তথ্যসূত্র: সিএনএন