লেবাননের প্রেসিডেন্ট ২০২৫ সালের মধ্যে হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের পর এই পদক্ষেপের কথা জানান প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন।
মঙ্গলবার প্রকাশিত আল-আরাবি আল-জাদিদকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমরা আশা করি হিজবুল্লাহর অস্ত্রশস্ত্র হয় প্রত্যাহার করা হবে, অথবা সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের হাতে আসবে। আমি এই লক্ষ্যেই কাজ করছি।”
১৯৮০-র দশকে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে হিজবুল্লাহর জন্ম হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি লেবাননের একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরেই তারা অস্ত্র সমর্পণে রাজি হচ্ছিল না। প্রেসিডেন্ট আউন জোর দিয়ে বলেন, এই প্রক্রিয়া আলোচনার মাধ্যমেই সম্পন্ন করতে হবে।
তিনি বলেন, “আমরা হিজবুল্লাহর অস্ত্র চাই, তবে গৃহযুদ্ধ চাই না।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, হিজবুল্লাহ অস্ত্র রাখতে চাইলেও ইসরায়েলের দুর্বল করা এবং লেবাননের সরকারের চাপ তাদের একসময় অস্ত্র সমর্পণে রাজি করাতে পারে। গত বছর ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর আগে হিজবুল্লাহ মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত ছিল।
তাদের হাতে কয়েক হাজার ক্ষেপণাস্ত্র এবং সুপ্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনী রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট আউন আরও জানান, বিষয়টি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো হিজবুল্লাহর সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে সংসদের স্পিকার এবং হিজবুল্লাহর মিত্র শিয়া রাজনীতিবিদ নাবিল বেরি অস্ত্রশস্ত্রের ওপর রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকারের বিষয়ে “পূর্ণ সমর্থন” দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত বছর ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি আলোচনায় বেরি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছিলেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, একদিকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ, অন্যদিকে আউনের অবস্থান বেশ কঠিন। আন্তর্জাতিক সংকট গবেষণা সংস্থার (International Crisis Group) একজন বিশ্লেষক ডেভিড উডস সিএনএনকে বলেছেন, “প্রেসিডেন্ট আউন হিজবুল্লাহর সঙ্গে রাষ্ট্রের জটিল পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত আছেন। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও সম্ভবত তাদের এখনও যথেষ্ট সামরিক শক্তি রয়েছে।”
গত সপ্তাহে হিজবুল্লাহর আইনপ্রণেতা হাসান ফাদলাল্লাহ এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের প্রতিরক্ষা কৌশল নিয়ে লেবানন সরকারের সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত থাকার কথা জানান। উডস মনে করেন, এই প্রস্তাব আউনের প্রস্তাবকে খুব বেশি আক্রমণাত্মক হিসেবে দেখাচ্ছে না।
আউন বলেন, আঞ্চলিক পরিস্থিতিও বদলেছে। তিনি ইরানের সঙ্গে মিত্র মিলিশিয়াদের সম্পর্ককে ইঙ্গিত করেন।
হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের জনসমর্থন বাড়িয়েছে। তবে গত বছরের বিপর্যয়কর যুদ্ধের পর তারা কীভাবে রাজনৈতিক বৈধতা খুঁজে বের করবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
আউন আরও জানান, তিনি মার্কিন কর্মকর্তাদের বলেছেন, লেবাননের দক্ষিণে ইসরায়েলের উপস্থিতি হিজবুল্লাহকে সশস্ত্র থাকার অজুহাত সরবরাহ করে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে তারা ওই অঞ্চল থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়।
লেবানন সরকার বারবার ইসরায়েলের হামলাকে তাদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন এবং যুক্তরাষ্ট্র-মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির পরিপন্থী হিসেবে বর্ণনা করেছে।
ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করলে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে আলোচনার সম্ভাবনা আছে কিনা জানতে চাইলে আউন বলেন, রাজনীতিতে সবকিছু সম্ভব, তবে সেখানকার পরিস্থিতিই বাস্তবতা নির্ধারণ করে।
তিনি আরও বলেন, “আমেরিকানরা বর্তমানে জানে, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা বা শান্তি আলোচনা করা সম্ভব নয়। আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো সীমান্তের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।”
আউন মনে করেন, ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা এখনো আছে, তবে তা সম্ভবত ঘটবে না।
তিনি যোগ করেন, হিজবুল্লাহ সম্প্রতি “তাদের ক্ষতির পরেও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে।”
হিজবুল্লাহর নিরস্ত্রীকরণ আঞ্চলিক গতিশীলতার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। কয়েক মাস আগেও এই গোষ্ঠী ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী আঞ্চলিক মিত্র হিসেবে পরিচিত ছিল। ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের পাল্টাপাল্টি হামলায় অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা নিহত হয়েছে।
প্রতিবেশী সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতনও এই গোষ্ঠীকে দুর্বল করেছে।
লেবানন যখন ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান সীমান্ত সংঘর্ষ এবং কয়েক বছরের অর্থনৈতিক দুরবস্থার সঙ্গে লড়াই করছে, তখন হিজবুল্লাহ সম্ভবত তাদের নিজেদের সমর্থক গোষ্ঠীর কাছ থেকেও অস্ত্র ত্যাগ করার চাপ অনুভব করতে পারে।
উডসের মতে, নিরস্ত্রীকরণ যুদ্ধের পরে পুনর্গঠন সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে বাধা দূর করতে পারে, যা হিজবুল্লাহর অনেক সমর্থকের জন্য জরুরি।
এছাড়াও, ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক আলোচনায় সহায়ক হিসেবে এই অস্ত্র সমর্পণকে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইরান এই অঞ্চলের গোষ্ঠীটিকে দেওয়া সমর্থন আলোচনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। সম্প্রতি ওমানে দুই দেশের প্রতিনিধি দলের মধ্যে বৈঠক হয়েছে এবং শনিবার তাদের মধ্যে দ্বিতীয় দফা আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন