বিশ্ব অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে আঘাত, ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে চীনের ‘ক্রিসমাস টাউন’-এর ব্যবসায় ক্ষতি।
প্রতি বছর শীতকালে যখন চারিদিকে তুষারপাতের দৃশ্য দেখা যায়, ক্রিসমাসের আলোয় ঘর সাজানো হয়, তখন আমাদের মনে আনন্দ জাগে। এই উৎসবের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই আসে চীনের একটি শহর থেকে, যার নাম ‘ক্রিসমাস টাউন’।
কিন্তু প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতির কারণে সেই শহরের ব্যবসায়ীরা এখন গভীর উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন।
চীনের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ইইউ শহরের প্রায় নব্বই শতাংশ ক্রিসমাস সামগ্রীর যোগান দেয়, যা বিশ্বজুড়ে ক্রিসমাস উৎসবের জন্য অপরিহার্য। এখানকার পাইকারি বাজারটি বিশাল, যা প্রায় ৭৫০টি ফুটবল মাঠের সমান।
এই বাজারে ক্রিসমাসের সাজসজ্জা থেকে শুরু করে খেলনা, সবই পাওয়া যায়। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে এখন সেখানে এক অস্থিরতা বিরাজ করছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে দীর্ঘদিনের বাণিজ্য সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ফলস্বরূপ এই শহরের ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বর্তমানে চীনের পণ্যের উপর ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গত এক শতাব্দীর মধ্যে সর্বোচ্চ।
এই পদক্ষেপের কারণে অনেক ব্যবসায়ী তাদের গ্রাহক হারাচ্ছেন এবং লাভের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।
ইইউ-এর একজন ব্যবসায়ী রান হংইয়ান, যিনি ১৫ বছর ধরে ক্রিসমাসের সাজসজ্জা বিক্রি করেন, তিনি জানান যে, শুল্কের কারণে তার অনেক আমেরিকান গ্রাহক ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন।
তার ক্ষতির পরিমাণ ১৩৫,০০০ মার্কিন ডলারের বেশি। তিনি বলেন, “আমাদের অনেক পুরনো ক্লায়েন্ট ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে, যা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক।”
এই পরিস্থিতি শুধু ইইউ-এর ব্যবসায়ীদের একার নয়, বরং বিশ্ব অর্থনীতির জন্যও উদ্বেগের কারণ। কারণ, এই ধরনের পণ্য তৈরি করা হয়, যা সহজে আমেরিকাতে তৈরি করা সম্ভব নয়।
এমনকি কম্বোডিয়াতেও ক্রিসমাসের সামগ্রী তৈরি হয়, যেখানে মজুরি চীন থেকেও কম, কিন্তু সেখানেও ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
ইইউ শহরটি চীনের অন্যান্য শহরের তুলনায় ছোট হলেও, বিশ্ব বাণিজ্যে এর প্রভাব অনেক বেশি। স্থানীয় তথ্য অনুযায়ী, গত বছর এই শহর থেকে ৮১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ১১.৫ বিলিয়ন ডলার ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য।
বিমানবন্দরের বাইরে লাগানো বিজ্ঞাপনগুলিও এর প্রমাণ দেয়, যেখানে লেখা ছিল: “চীনের পণ্য! ইইউ-তে বিশ্ব ব্যবসা করুন।”
বর্তমানে, এই বাজারের অনেক দোকানে বিদেশি ক্রেতাদের আনাগোনা দেখা গেলেও, কোনো আমেরিকান ক্রেতার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। দোকানদাররা উদ্বেগের সঙ্গে কথা বলছেন এবং স্থানীয় কর্মকর্তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকছেন।
এমনকি যারা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করেন না, তারাও এই পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত।
বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে ইইউ-এর ব্যবসায়ীরা এখন নতুন বাজারের দিকে ঝুঁকছেন। কেউ কেউ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারে তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটাচ্ছেন। কেউ আবার অনলাইনে ব্যবসা শুরু করেছেন।
ইইউ-এর একজন ব্যবসায়ী নি জিচিন, যিনি হ্যালোইনের সাজসজ্জা বিক্রি করেন, তিনি বলেন, “আমি এখন আমার আমেরিকান গ্রাহকদের জন্য তৈরি পণ্যগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে পাঠাচ্ছি।” তার ব্যবসার প্রায় অর্ধেক আগে যুক্তরাষ্ট্রে যেত, কিন্তু এখন সেই পরিমাণ কমে গেছে।
তিনি আরও বলেন, “আমার এখনও অভ্যন্তরীণ বাজার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার আছে। আমি অনলাইন ব্যবসার দিকেও মনোযোগ দিচ্ছি।”
এই বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে চীনের অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়ছে, তাতে অনেকেই হতাশ। তাদের আশঙ্কা, এই পরিস্থিতি তাদের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলবে। এমনকি, অনেকে তাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বিগ্ন।
ইইউ-এর একজন ব্যবসায়ী লি জিনিয়াও, যিনি প্লাস্টিকের ফুল বিক্রি করেন, তিনি বলেন, “আমরা বিশ্ব শান্তি চাই। আমি বুঝি না কেন তারা এমনটা করছে।”
এই ব্যবসায়ীরা আশা করেন, দুই দেশের নেতারা দ্রুত একটি সমাধানে পৌঁছাবেন এবং এই বাণিজ্য যুদ্ধের অবসান হবে। কিন্তু পরিস্থিতি যদি এমনই চলতে থাকে, তবে তাদের ব্যবসা এবং জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন