মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতা: ট্রাম্পের মন্তব্যের প্রেক্ষাপটে উদ্বেগের সৃষ্টি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফেডারেল রিজার্ভের (ফেড) প্রধান জেরোম পাওয়েলের উপর আক্রমণ তীব্র করেছেন। একই সময়ে, দেশটির সুপ্রিম কোর্ট এমন একটি মামলার শুনানির বিবেচনা করছে যা প্রেসিডেন্টের জন্য পাওয়েলকে বরখাস্ত করা সহজ করে দিতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হলে তা বাজারের অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুলবে এবং অর্থনীতির অনিশ্চয়তা আরও ঘনীভূত হবে।
ফেডারেল রিজার্ভ, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে পরিচিত, দেশটির অর্থনীতিতে বিশাল ক্ষমতা রাখে। স্বল্পমেয়াদী সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে, যা তারা সাধারণত অর্থনীতির দুর্বলতার সময় কমিয়ে আনে, ফেড ঋণ নেওয়াকে সহজ করে এবং আরও বেশি ব্যয়ের সুযোগ তৈরি করে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাড়াতে সহায়ক হয়। অন্যদিকে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদের হার বাড়িয়ে তারা অর্থনীতিকে শীতল করতে পারে এবং এর ফলে চাকরির বাজারেও প্রভাব ফেলতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। কারণ, তারা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠিন পদক্ষেপ নিতে পারে, যেমন সুদের হার বাড়ানো। ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকের উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়কালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা রক্ষার গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয়েছিল। সে সময়ে, তৎকালীন ফেডারেল রিজার্ভ চেয়ারম্যান আর্থার বার্নসকে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়েছিল, যিনি ১৯৭২ সালের নির্বাচনের আগে সুদের হার কম রাখতে চেয়েছিলেন।
পরবর্তীতে, ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সময় পল ভলকারকে ফেডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তিনি সুদের হার প্রায় ২০ শতাংশে উন্নীত করেন। এর ফলে তীব্র মন্দা দেখা দিলেও, ভলকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। অর্থনীতিবিদদের মতে, ভলকারের এই পদক্ষেপ ছিল একটি স্বাধীন ফেডারেল রিজার্ভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।
শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে, পাওয়েলকে বরখাস্ত করার কোনো প্রচেষ্টা সম্ভবত শেয়ারের দাম কমিয়ে দেবে এবং বন্ডের ফলন বাড়িয়ে দেবে। এর ফলে সরকারি ঋণের সুদের হার বাড়বে এবং বন্ধকী ঋণ, গাড়ির ঋণ ও ক্রেডিট কার্ডের ঋণের খরচও বৃদ্ধি পাবে। বিনিয়োগকারীরা একটি স্বাধীন ফেডারেল রিজার্ভ পছন্দ করেন, কারণ এটি সাধারণত রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে মূল্যস্ফীতিকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং এর সিদ্ধান্তগুলো আরও সহজে অনুমেয় হয়।
তবে, এর অর্থ এই নয় যে ফেড সম্পূর্ণভাবে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। পাওয়েলের মতো ফেড চেয়ারম্যানদের প্রেসিডেন্ট চার বছরের জন্য নিয়োগ দেন এবং সিনেটের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। প্রেসিডেন্ট ফেডের পরিচালনা পর্ষদের অন্য ছয় সদস্যকেও নিয়োগ করেন, যাদের মেয়াদ ১৪ বছর পর্যন্ত হতে পারে। এই নিয়োগের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট সময়ের সাথে সাথে ফেডের নীতিগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতিমধ্যে সাত সদস্যের মধ্যে পাঁচজনকে নিয়োগ দিয়েছেন।
এদিকে, কংগ্রেস আইনের মাধ্যমে ফেডের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারে। ১৯৭৭ সালে, কংগ্রেস ফেডকে মূল্য স্থিতিশীলতা এবং সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার দ্বৈত লক্ষ্য প্রদান করে। ফেড স্থিতিশীল মূল্যকে ২ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। এছাড়াও, ১৯৭৭ সালের আইনে ফেড চেয়ারম্যানকে প্রতি বছর দুবার কংগ্রেসের উভয় কক্ষে অর্থনীতি ও সুদের হার নীতি সম্পর্কে সাক্ষ্য দিতে হয়।
কিন্তু, প্রেসিডেন্ট কি পাওয়েলকে বরখাস্ত করতে পারেন?
পাওয়েলের মতে, ফেড প্রতিষ্ঠার আইন প্রেসিডেন্টকে কেবল কারণ দর্শিয়ে চেয়ারম্যানকে বরখাস্ত করার অনুমতি দেয়। যদিও এক্ষেত্রে কিছু জটিলতা রয়েছে। কারণ পাওয়েলকে প্রথমে ফেডের গভর্নিং বোর্ডের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল এবং পরে ট্রাম্প তাকে চেয়ারম্যান পদে উন্নীত করেন (২০১৭ সালে)।
অধিকাংশ আইনজ্ঞ মনে করেন, ট্রাম্প ফেডের গভর্নিং বোর্ড থেকে পাওয়েলকে বরখাস্ত করতে পারবেন না। তবে, প্রেসিডেন্ট তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরাতে পারেন কিনা, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যদি ট্রাম্প পাওয়েলকে বরখাস্ত করার চেষ্টা করেন, তবে বিষয়টি সম্ভবত সুপ্রিম কোর্টে গড়াবে।
সুপ্রিম কোর্ট কী করতে পারে?
বর্তমানে, সুপ্রিম কোর্টে এমন একটি মামলার শুনানি চলছে, যেখানে প্রেসিডেন্ট স্বাধীন সংস্থাগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করতে পারেন কিনা, তা বিবেচনা করা হচ্ছে। এই মামলার রায় সম্ভবত গ্রীষ্মকালে আসতে পারে।
ফেডের স্বাধীনতা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং মুদ্রার বিনিময় হারের উপর প্রভাব ফেলে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি, বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিশীলতা এবং আমাদের দেশের অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস