লিথুয়ানিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর, কাউনাস: ইতিহাসে মোড়া এক গন্তব্য।
বাল্টিক অঞ্চলের একটি উল্লেখযোগ্য শহর হলো কাউনাস, যা লিথুয়ানিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হিসেবে পরিচিত। এটি শুধু একটি শহর নয়, বরং ইতিহাসের এক জীবন্ত সাক্ষী।
বিভিন্ন সময়ে এই শহরটি তেউতোনিক নাইট, রুশ সাম্রাজ্যের মতো বিভিন্ন শক্তির অধীনে ছিল, কিন্তু সংস্কৃতি এবং শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে এর নিজস্বতা সবসময় বজায় রেখেছে। রাজধানী ভিলনিয়াসের থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত কাউনাস, যা শুধু স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকেও আকর্ষণীয়।
এখানকার পুরনো শহরের গথিক স্থাপত্য থেকে শুরু করে আধুনিক নকশার অ্যাপার্টমেন্ট ভবনগুলো শহরের ঐতিহাসিক গভীরতার প্রমাণ দেয়।
কাউনাসে ভ্রমণের সেরা সময়।
বসন্তকালে, বিশেষ করে যখন নেমুনাস দ্বীপের সাকুরা পার্কের চেরি ফুল ফোটে, কাউনাস পরিদর্শনের উপযুক্ত সময়। এপ্রিল মাস থেকে এখানে কাওনাস জ্যাজ উৎসব শুরু হয়, যা সাংস্কৃতিক উৎসবের সূচনা করে।
মে মাসের শেষের দিকে শহরের জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হয় নানা কনসার্ট, পারফরম্যান্স এবং ‘পুটভিনস্কিস স্ট্রিট ডে’ এর মতো আকর্ষণীয় আয়োজনের মাধ্যমে। এছাড়া, নেমুনাস এবং নেরিস নদীগুলোর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ‘সেলিব্রেট দ্য রিভার’ নামক একটি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়।
মে মাসের শেষে শুরু হওয়া ‘পাজাইসলিস মিউজিক ফেস্টিভ্যাল’-ও (৩০তম বর্ষ) একটি উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ।
গ্রীষ্মকালে, বিশেষ করে জুলাই ও আগস্ট মাসে কাউনাসের পুরনো শহরে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ে। এসময় ক্যাফেগুলো খোলা থাকে এবং স্থানীয়রা নৌকা নিয়ে কাউনাস লেগুন আঞ্চলিক পার্কে ঘুরতে যায়।
সেপ্টেম্বরে, শিল্প প্রেমীদের জন্য ‘কাউনাস কালচার ফেয়ার’ এবং ‘কাউনাস বাইয়েনিয়াল’-এর মতো অনুষ্ঠানগুলো উপভোগ করার সুযোগ থাকে। শীতকালে এখানকার ক্রিসমাস বাজার, ক্লেইবোনিস্কিস ফরেস্ট পার্কে স্কেটিং এবং তুষারে ঢাকা পুরনো শহরের সৌন্দর্য ভ্রমণকারীদের মন জয় করে।
কাউনাসের দর্শনীয় স্থানসমূহ।
কাউনাসের প্রধান আকর্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মধ্যযুগীয় কাউনাস ক্যাসেল, যা নেমুনাস এবং নেরিস নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। ক্যাসেলের দেয়াল থেকে শহরের পুরনো শহরের সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়।
পায়ে হেঁটে পুরনো শহরের কেন্দ্রস্থল ভিলনিয়াস স্ট্রিটে গেলে ষোড়শ শতাব্দীর পুরনো ভবনগুলো দেখা যায়, যেখানে বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট ও বুটিক অবস্থিত।
সেন্ট পিটার এবং সেন্ট পল ক্যাথেড্রাল-বেসিলিকা হলো গথিক স্থাপত্যের এক দারুণ উদাহরণ, যা টাউন হল স্কয়ারের পাশে অবস্থিত। এছাড়াও, ‘হোয়াইট সোয়ান’ নামে পরিচিত কাউনাস টাউন হলও একটি উল্লেখযোগ্য স্থান।
একসময় এটি কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে এখানে কাউনাস সিটি মিউজিয়াম অবস্থিত, যেখানে ইতিহাস, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি এবং শিল্পের বিভিন্ন প্রদর্শনী দেখা যায়।
পুরনো শহরের বাইরে, নওয়ামেস্টি (নতুন শহর) আধুনিক স্থাপত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই এলাকাটি ২০২৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
এখানে ক্রাইস্টস রিজারেকশন ব্যাসিলিকা ও জালকালনিসের সবুজ পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। এছাড়া, ফুটপাথ ধরে হেঁটে পুটভিনস্কিও স্ট্রিট এবং লাইসভেস অ্যাভিনিউ-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে যাওয়া যেতে পারে।
কাউনাসের সংস্কৃতি ও শিল্প।
কাউনাস তার সমৃদ্ধ শিল্পকলার জন্য বিখ্যাত। এখানে এম কে সিউরলিনিস আর্ট মিউজিয়ামে ১৯ শতকের চিত্রশিল্পী ও সুরকারের কাজ দেখা যায়। কাউনাস পিকচার গ্যালারিতে আধুনিক লিথুয়ানীয় এবং আন্তর্জাতিক শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়।
এছাড়া, ইয়ার্ড গ্যালারিতে শহরের আধুনিক জীবন ও রাস্তার শিল্পের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। এখানকার স্ট্রিট আর্ট রুটে ‘দ্য ওয়াইজ ওল্ড ম্যান’-এর মতো বিখ্যাত ম্যুরালগুলো দেখা যায়, যা শহরের সংস্কৃতিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
বিজ্ঞান ভালোবাসেন এমন মানুষের জন্য নেমুনাস নদীর তীরে অবস্থিত ‘সায়েন্স আইল্যান্ড’ একটি চমৎকার স্থান। এখানে প্ল্যানেটোরিয়াম এবং ১৪০টিরও বেশি ইন্টারেক্টিভ প্রদর্শনী রয়েছে।
এছাড়াও, বাস্কেটবল প্রেমীদের জন্য জালগিরিও অ্যারেনা একটি বিশেষ আকর্ষণ, যেখানে তারা লিথুয়ানিয়ার জাতীয় খেলা বাস্কেটবলের উত্তেজনা উপভোগ করতে পারে।
কাউনাসের খাদ্যরসিকতা।
কাউনাস মাংসপ্রিয় মানুষের জন্য একটি আদর্শ স্থান। এখানে ‘মেডজিয়োটোজু উজেগা’ -তে হরিণের মাংসের মিটবল, রো হরিণের মাংসের স্টেক এবং বুনো শূকরের সসেজের মতো বিভিন্ন খাবার উপভোগ করা যেতে পারে।
‘বেরনেলিও উজেগা’ -তে ঐতিহ্যবাহী লিথুয়ানীয় খাবার যেমন—জেপেলিন (আলু ও পনির দিয়ে তৈরি), শালতিবারসিয়াই (বিটরুট, শসা, পেঁয়াজ ও ডিল দিয়ে তৈরি একটি ঠান্ডা স্যুপ) পাওয়া যায়।
২০২৪ সালে, মিশেলিন গাইড লিথুয়ানিয়ার কাউনাসে পাঁচটি রেস্টুরেন্টকে তালিকাভুক্ত করেছে। এর মধ্যে ‘উওকস’ -এ বাল্টিক অঞ্চলের উপকরণ দিয়ে তৈরি খাবার পরিবেশন করা হয়, যেমন—ব্ল্যাক ট্রাফল ও ফারমেন্টেড বিটের সাথে স্টারজন মাছ।
‘মন্টে প্যাসিস’ -এ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত উপাদান দিয়ে তৈরি সিজনাল মেনু উপভোগ করা যায়।
ঐতিহ্যপূর্ণ স্বাদের জন্য স্পুরগিন-এ যেতে পারেন, যেখানে সোভিয়েত যুগের রেসিপি ও পরিবেশ এখনো বিদ্যমান।
কাউনাসে থাকার ব্যবস্থা।
কাউনাসে থাকার জন্য পুরনো শহর অথবা নতুন শহরের কাছাকাছি স্থান নির্বাচন করা যেতে পারে। পুরনো শহরে থাকলে ঐতিহাসিক স্থাপত্য এবং নদীর দৃশ্য উপভোগ করা যায়, অন্যদিকে নতুন শহরে থাকলে রেস্টুরেন্ট ও নাইটলাইফের সুযোগ পাওয়া যায়।
নতুন শহরের লাইসভেস অ্যাভিনিউতে অবস্থিত ‘ভিইসবুটিস কাউনাস’ একটি আরামদায়ক হোটেল। পুরনো শহরে, ‘বোহেম হাউস’-এর আটটি অ্যাপার্টমেন্টে কাউনাসের আন্তঃযুদ্ধকালীন সময়ের জীবনযাত্রার ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
এছাড়াও, ‘দaugirdas’ হোটেলে ষোড়শ শতাব্দীর ওয়াইন সেলার এবং আধুনিক গেস্ট উইং-এর সাথে একটি বারান্দা রয়েছে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক