মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে মানুষের কৌতূহল সবসময়ই আকাশচুম্বী। আমরা কি একা? সৌরজগতের বাইরে অন্য কোনো গ্রহে কি প্রাণের সম্ভাবনা আছে? সম্প্রতি, বিজ্ঞানীরা তেমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST) ব্যবহার করে তারা K2-18b নামের একটি বহির্গ্রহের বায়ুমণ্ডলে এমন একটি গ্যাসের সন্ধান পেয়েছেন যা প্রাণের ইঙ্গিত দিতে পারে। আসুন, এই চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার এবং এর পেছনের বিজ্ঞানীদের বিতর্ক সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
K2-18b গ্রহটি আমাদের পৃথিবী থেকে বেশ কয়েক আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এবং এটি তার নক্ষত্রের বাসযোগ্য অঞ্চলে (habitable zone) অবস্থান করে। সহজ ভাষায় বললে, এই অঞ্চলে একটি গ্রহের পৃষ্ঠে তরল আকারে পানি থাকার সম্ভাবনা থাকে, যা জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য।
বিজ্ঞানীরা এই গ্রহের বায়ুমণ্ডলে ডাইমিথাইল সালফাইড (dimethyl sulfide বা DMS) নামক একটি গ্যাসের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন। এই গ্যাসটি পৃথিবীতে মূলত কিছু বিশেষ ধরনের শৈবাল (phytoplankton) তৈরি করে।
আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীরা বলছেন, K2-18b-তে DMS-এর উপস্থিতি সম্ভবত প্রাণের চিহ্ন। তাঁদের মতে, এটি একটি ‘বায়োসইগনেচার’ বা জীবনের ইঙ্গিত হতে পারে। তবে, এই আবিষ্কার নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
অনেকেই এই দাবির সত্যতা নিয়ে সন্দিহান। তাঁদের মতে, DMS-এর উপস্থিতি জীবনের প্রমাণ নাও হতে পারে। কারণ, এই গ্যাসটি নির্জীব রাসায়নিক প্রক্রিয়া থেকেও তৈরি হতে পারে।
এই আবিষ্কারের মূল ভিত্তি হলো JWST থেকে পাওয়া ডেটা। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, তাঁরা DMS-এর উপস্থিতি ‘থ্রি সিগমা’ স্তরে শনাক্ত করতে পেরেছেন। এর অর্থ হলো, এই গ্যাসের উপস্থিতি নিছক কাকতালীয়ভাবে ঘটার সম্ভাবনা ০.৩ শতাংশের কম।
যদিও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে বিজ্ঞানীরা একে চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে মানতে নারাজ। কারণ, সাধারণত কোনো আবিষ্কারকে নিশ্চিত প্রমাণ হিসেবে গণ্য করতে ‘ফাইভ সিগমা’ স্তরের গুরুত্ব প্রয়োজন হয়।
বিষয়টি নিয়ে সন্দিহান বিজ্ঞানীরা বলছেন, K2-18b-এর বায়ুমণ্ডলের রাসায়নিক গঠন এবং গ্রহটির পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের খুব বেশি ধারণা নেই। ফলে, DMS-এর উৎস জীবন না হয়ে অন্য কোনো ভৌত বা রাসায়নিক প্রক্রিয়াও হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, এই গ্যাসটি আগ্নেয়গিরি অথবা অন্য কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে তৈরি হতে পারে। এমনকি, K2-18b-এর পরিবেশ পৃথিবীর মতো বাসযোগ্য নাও হতে পারে।
কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, গ্রহটিতে কোনো কঠিন ভূমি নেই, বরং এটি গ্যাসীয় পদার্থ দিয়ে গঠিত। আবার কারো কারো মতে, এর পৃষ্ঠে তরলের বদলে থাকতে পারে উত্তপ্ত লাভা।
তবে, এই বিতর্কের মাঝেও বিজ্ঞানীরা K2-18b নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা DMS-এর উপস্থিতি আরও ভালোভাবে যাচাই করার চেষ্টা করছেন। যদি সত্যিই DMS-এর উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায় এবং K2-18b-কে একটি বাসযোগ্য গ্রহ হিসেবে প্রমাণ করা যায়, তবে এটি হবে মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
এর মাধ্যমে ভিনগ্রহে প্রাণের অনুসন্ধান আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। সুতরাং, K2-18b-এর আকাশে প্রাণের সম্ভাবনা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও দ্বিধা বিভক্ত।
অন্যদিকে, নিশ্চিত প্রমাণ পেতে আরও অনেক গবেষণা প্রয়োজন। তবে, এই আবিষ্কার মহাকাশে প্রাণের সন্ধান বিষয়ক গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক।
সুতরাং, K2-18b-এর আকাশে প্রাণের সম্ভাবনা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনও দ্বিধা বিভক্ত। একদিকে, DMS-এর উপস্থিতি একটি দারুণ সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক।