যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে রাশিয়ার ঘোষিত ‘ইস্টার যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণার শুরুতেই লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শনিবার মানবিক কারণে ইউক্রেন যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে ‘সামরিক কার্যক্রম বন্ধের’ নির্দেশ দেন। এই নির্দেশ অনুযায়ী, ৩০ ঘণ্টার জন্য উভয়পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি কার্যকর হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু বাস্তবে, যুদ্ধবিরতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কিয়েভসহ ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে সাইরেন বাজতে শুরু করে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অভিযোগ করেন, রাশিয়া তাদের আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে এবং এটিকে একটি ‘লোক দেখানো কৌশল’ হিসেবে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও পাল্টা অভিযোগ করে জানায়, ইউক্রেন এক হাজারেরও বেশি বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে।
যুদ্ধবিরতির সময়সীমা নিয়ে দুই দেশের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। কিয়েভে বসবাসকারী নাতালিয়া মালায়েভা জানান, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরপরই কিয়েভে বিমান হামলার সাইরেন শোনা যায়।
তিনি বলেন, ‘ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন উড়ে আসছিল। ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরণও ঘটেছে। তাহলে এটা কেমন যুদ্ধবিরতি?’
অন্যদিকে, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় রবিবার এক বিবৃতিতে জানায়, ইউক্রেনীয় বাহিনী তাদের অবস্থানে ৪৪৪ বার গুলি চালিয়েছে এবং ৯০০টির বেশি ড্রোন হামলা চালিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, ব্রায়ানস্ক, কুর্স্ক ও বেলগোরোদ সীমান্ত অঞ্চলগুলোও আক্রান্ত হয়েছে।
এতে বেসামরিক লোক হতাহত হয়েছে এবং সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলের বুদেনোভস্কি জেলায় অন্তত তিনটি বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে, যা ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রুশ সংবাদ সংস্থা তাস-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনীয় বাহিনী যুদ্ধবিরতির সময় এই হামলা চালিয়েছে।
যদিও ইউক্রেন তাৎক্ষণিকভাবে এর কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
ইউক্রেনীয় সামরিক মুখপাত্র ভিক্টর ট্রেহুবভ জানান, যুদ্ধ কিছুটা কমলেও, এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে, আমরা এটা নিয়ে বেশি আশা করিনি।’
বিশ্লেষকদের মতে, তাৎক্ষণিকভাবে সব ধরনের যুদ্ধ বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। তবে বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত এবং আক্রমণের সংখ্যাও কমেছে।
মস্কো থেকে আল জাজিরার প্রতিনিধি ইউলিয়া শাপোভালোভা জানান, উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছে। তিনি আরও বলেন, ‘রাশিয়ার পক্ষ থেকে এই যুদ্ধবিরতির প্রতি ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
মানুষ আশা করছে, এটি দীর্ঘস্থায়ী হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টার কারণেও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি ও শান্তি আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে।’
অন্যদিকে, রাশিয়ার সাবেক উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে ফেডোরভ পুতিনের এই ঘোষণাকে ‘রাজনৈতিক পদক্ষেপ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, রাশিয়া এবং ইউক্রেন উভয়ের জন্যই ইস্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব।
এই ছুটির দিনে পুতিন দেখাতে চেয়েছেন যে তিনি রুশ অর্থোডক্স চার্চের ঐতিহ্য অনুসরণ করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন জানিয়েছে, রাশিয়া বা ইউক্রেন যদি যুদ্ধ বন্ধ করতে কঠিন করে তোলে, তাহলে তারা এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না।
ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আল জাজিরার প্রতিনিধি রোজালিন্ড জর্ডান জানিয়েছেন, বর্তমানে কোনো পক্ষই ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে বিবাদে জড়াতে চাইছে না।
মস্কোর ইকোনমিকস-এর উচ্চ বিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ভ্লাদিমির সতনিকভ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ট্রাম্প সম্ভবত এমন একটি শান্তি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন যা অদূর ভবিষ্যতে কাজে আসবে না।
তিনি আরও বলেন, ‘উভয় পক্ষই—ইউক্রেন ও রাশিয়া—এখনও আলোচনার টেবিলে বসার মতো মানসিকতায় আসেনি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, উভয়পক্ষের মধ্যে গভীর আস্থার সংকট রয়েছে।’
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা