রুমেনিয়ায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের হাওয়া: ডানপন্থী বনাম সংস্কারপন্থী লড়াই

রুমেনিয়ায় আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। আগামী রবিবার অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই নির্বাচনে একদিকে লড়ছেন একজন ডানপন্থী রাজনীতিক, যিনি জনসাধারণের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়, অন্যদিকে রয়েছেন একজন সংস্কারপন্থী প্রযুক্তিবিদ।

দেশের ইতিহাসে সম্ভবত এমন মেরুকরণ আগে দেখা যায়নি। জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে পারে।

এই নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন অ্যালায়েন্স ফর দ্য ইউনিয়ন অফ রোমানিয়ানস (AUR) দলের নেতা জর্জে সিমিয়ন এবং বুখারেস্টের বর্তমান মেয়র ও স্বতন্ত্র প্রার্থী নিকুসোর ড্যান।

দেশের প্রায় ১৯ মিলিয়ন ভোটারের মধ্যে এক চতুর্থাংশেরই বাস এই বুখারেস্টে। সিমিয়ন নিজেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং হাঙ্গেরির অভিবাসন-বিরোধী নেতা ভিক্টর অরবানের মতো নেতাদের কাতারে ফেলেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) ও ন্যাটো’র সদস্য এবং ইউক্রেনের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে এই নির্বাচনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমা দেশগুলো বর্তমানে ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত—যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কমে যাওয়ার আশঙ্কা, মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া এবং রাশিয়ার সঙ্গে কিভাবে মোকাবিলা করা যায়, সেই বিষয়গুলো নিয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।

মে মাসের প্রথম রাউন্ডের নির্বাচনে ৩৮ বছর বয়সী সিমিয়ন প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে এগিয়ে ছিলেন। অন্যদিকে, সাবেক গণিতবিদ ড্যান পেয়েছিলেন ২০ শতাংশের মতো ভোট।

এর আগে, অক্টোবর ২০২৪-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বাতিল করা হয়, যেখানে ক্যালিওন জর্জেস্কু নামের একজন অতি-জাতীয়তাবাদী প্রার্থী চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছেছিলেন। আদালত নির্বাচনে আর্থিক অনিয়ম এবং বিদেশি হস্তক্ষেপের অভিযোগ এনেছিলেন।

সিমিয়ন জানিয়েছেন, জনগণের ইচ্ছা থাকলে তিনি ২০২৪ সালের নির্বাচনের দ্বিতীয় দফা আবার আয়োজন করতে প্রস্তুত। তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত প্রার্থী জর্জেস্কুর সমর্থক এবং প্রথম রাউন্ডে তাঁর অনেক ভোটারকে আকৃষ্ট করেছেন।

সিমিয়ন জর্জেস্কুকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসানোরও কথা বলেছেন।

সিমিয়ন একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। তাঁকে ইউক্রেন ও মলদোভাতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। তিনি অতীতে রোমানিয়ার পুরনো সীমান্ত ফিরিয়ে আনারও আহ্বান জানিয়েছিলেন।

ইউক্রেনকে আরও সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়েও তিনি সন্দিহান। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি বিভিন্ন সময় বিক্ষোভ করেছেন এবং জাতীয়তাবাদী র‍্যালিও করেছেন। তিনি ২০২০ সালে AUR প্রতিষ্ঠা করেন।

সিমিয়ন আরও বলেন, “আমি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে সবার আগে নির্বাচনের বাতিলের ফাইলগুলো খোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য, আমাদের সত্য জানতে হবে।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক আনামারিয়া-নিকোলেটা সিওবানু সিমিয়নকে একজন “রঙ বদলানো নেতা” হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যিনি শুরুতে কিছুটা নরমপন্থী ছিলেন, কিন্তু পরে চরম ডানপন্থার দিকে ঝুঁকেছেন।

অন্যদিকে, ড্যান নিজেকে দুর্নীতিবিরোধী হিসেবে পরিচিত করেছেন। তিনি ২০১৫ সালে ‘সেভ রোমানিয়া ইউনিয়ন’ নামে একটি দল গঠন করেছিলেন, যা পরে তিনি ছেড়ে দেন।

তিনি এই দলকে ‘সংস্কারপন্থী’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। মূলত, শহরাঞ্চলে তাঁর সমর্থক বেশি। তিনি ডানপন্থীদের উত্থানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চান।

ড্যান জানান, “আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছি, কারণ রোমানীয়রা ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে।”

ড্যানের দল নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ৬ লক্ষ ইউরো (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা) সংগ্রহ করেছে। প্রথম রাউন্ডে সিমিয়নের চেয়ে পিছিয়ে থাকার পর, নির্বাচনে জয়ী হতে তাঁর এখন বড় সমর্থন প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, গত বছরের নির্বাচনের ঘটনা প্রমাণ করেছে যে রোমানীয়রা ‘ভয় ও আশার মধ্যে, নিজেদের দিকে তাকানো ও এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে’ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন।

ড্যানের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে রয়েছে—ট্যাক্স ফাঁকি, জালিয়াতি ও মাদক পাচার বন্ধ করা এবং রোমানিয়ার বিশাল প্রবাসী জনগোষ্ঠীর (প্রায় ২৫ শতাংশ) দেশে ফেরার পরিবেশ তৈরি করা।

প্রথম রাউন্ডে রেকর্ড সংখ্যক প্রবাসী রোমানীয় ভোটার ভোট দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ সিমিয়নকে এবং ২৫ শতাংশ ড্যানকে সমর্থন করেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিওবানু মনে করেন, সিমিয়নের কারণে রোমানিয়ার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তিনি বলেন, “জর্জে সিমিয়নকে উদারনৈতিক হিসেবে দেখা হয় না, যা তাঁর কাজ করার আগেই দেশের ভাবমূর্তি, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।”

তথ্য সূত্র: আল জাজিরা