মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতি বিশ্ব বাণিজ্যকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে এবং এর সম্ভাব্য প্রভাবগুলো কি, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে এখনো আলোচনা চলছে। তার শাসনামলে নেওয়া বিভিন্ন শুল্ক পদক্ষেপ বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি করেছিল, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর।
বিশেষ করে চীন, মেক্সিকো এবং কানাডার মতো দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
ক্ষমতায় আসার পর, ট্রাম্প মেক্সিকো ও কানাডার কিছু পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ এবং চীনের পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি মাদক পাচার এবং অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের কথা উল্লেখ করেছিলেন।
যদিও পরে তিনি কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর থেকে কিছু শুল্ক প্রত্যাহার করেন, চীনের ক্ষেত্রে তা বহাল ছিল। পরবর্তীতে ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম এবং গাড়ির যন্ত্রাংশের মতো পণ্যের ওপরও ২৫ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়।
এমনকি মেক্সিকো এবং কানাডার ওপর পুনরায় শুল্ক আরোপ করা হয়।
এরপর ট্রাম্প বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর “পাল্টা” শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন, যেখানে সব দেশের জন্য ১০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করা হয়। তবে, ওয়াল স্ট্রিটে দরপতনের পর এই শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়।
কিন্তু চীন এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে।
যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য পরবর্তীতে কিছু বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে শুল্ক কমানো শুরু করে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে একটি সীমিত বাণিজ্য চুক্তি উল্লেখযোগ্য।
এই চুক্তিতে যুক্তরাজ্যের অনেক পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক বহাল রাখা হয়, তবে ব্রিটিশ গাড়ির ওপর শুল্ক ২৭.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত।
দুই দেশই ৯০ দিনের জন্য শুল্ক কমানোর ঘোষণা দেয়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক ৩০ শতাংশ এবং চীন ১০ শতাংশে নামিয়ে আনে।
এর আগে, যুক্তরাষ্ট্র স্মার্টফোন, কম্পিউটার এবং অন্যান্য প্রযুক্তি পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করে, যা মূলত চীন থেকে আমদানি করা হতো।
এই শুল্ক কমানোর পদক্ষেপকে ব্যবসায়ীরা স্বাগত জানালেও, অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি।
অনেক কোম্পানি দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ বা সরবরাহ শৃঙ্খল (supply chain) সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা বোধ করছে।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা, যারা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এই শুল্কের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুল্ক নীতির এই অস্থিরতা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মন্দা ডেকে আনতে পারে।
ব্লুমবার্গ এর একটি জরিপে দেখা গেছে, আগামী বছর মন্দা আসার সম্ভাবনা প্রায় ৫০ শতাংশ।
যদিও এপ্রিল মাসে ভোক্তা মূল্যবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে, তবে বছরের মাঝামাঝি সময়ে তা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এমনকি, ভোক্তাদের আত্মবিশ্বাসও কমে গেছে।
ওয়ালমার্ট-এর মতো বৃহৎ খুচরা বিক্রেতারা, যারা চীন থেকে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করে, তারা শুল্কের কারণে পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে।
এমনকি ট্রাম্প নিজেও স্বীকার করেছেন যে এর ফলে পণ্যের দাম বাড়তে পারে।
এই পরিস্থিতিতে, প্রশ্ন উঠেছে ট্রাম্পের শুল্ক নীতির চূড়ান্ত ফল কী হবে?
অনেক কোম্পানি নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা দিলেও, শুল্ক নীতি কত দিন স্থায়ী হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
এই শুল্ক নীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য কিছু বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের এই বাণিজ্য নীতির কারণে বিশ্ববাজারে যে পরিবর্তন আসছে, তাতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তবে, কিছু ক্ষেত্রে নতুন বাজার তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র যদি চীন থেকে আমদানি কমাতে চায়, তাহলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বিকল্প সরবরাহকারী হিসেবে সুযোগ পেতে পারে।
একইসঙ্গে, বাংলাদেশের বাণিজ্য চুক্তি এবং নীতিগুলোকেও নতুন করে পর্যালোচনা করতে হবে, যাতে বিশ্ব অর্থনীতির এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করা যায়।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা