ভারতে ‘দেশদ্রোহী’ বানানোর খেলা: অধ্যাপক আলী খান মাহমুদাবাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
ভারতে একজন অধ্যাপককে ‘দেশদ্রোহী’ বানানোর অভিযোগ উঠেছে। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর মদতে পুলিশ ও বিচার বিভাগের সহায়তায় অধ্যাপক আলী খান মাহমুদাবাদকে হয়রানি করা হচ্ছে।
তিনি অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। অভিযোগ, মাহমুদাবাদ এমন কিছু করেননি, যা তার বিরুদ্ধে প্রমাণ করতে হবে। তার মানে, ‘দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত নির্দোষ’– এই ধারণার উল্টো পথে হাঁটা হচ্ছে।
অধ্যাপক মাহমুদাবাদের বক্তব্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টও ইতিমধ্যে তার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে।
এমনকি তার দুটি ফেসবুক পোস্টের বিষয় খতিয়ে দেখতে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল (এসআইটি) গঠন করা হয়েছে। অথচ, মাহমুদাবাদের পোস্টগুলোতে কোনো অস্পষ্টতা নেই।
সেখানে তিনি পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করার সমালোচনা করেছিলেন এবং ভারতের সামরিক পদক্ষেপের প্রশংসা করেছিলেন।
তিনি আরও উল্লেখ করেছিলেন, দুই নারী সেনা কর্মকর্তার প্রশংসা করা হয়েছে, যাদের একজন মুসলিম। এই ঘটনার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলকতার যে দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে, তা যদি ভারতে মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ না হয়, তবে তা নিছক ভণ্ডামি হিসেবেই থেকে যাবে।
অধ্যাপক মাহমুদাবাদের এই বক্তব্য অনেকের মতোই। কিন্তু হঠাৎ করেই হরিয়ানা রাজ্যের মহিলা কমিশনের প্রধান রেনু ভাটিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং মাহমুদাবাদের বিরুদ্ধে ওই দুই নারী সেনা কর্মকর্তার অবমাননার অভিযোগ আনেন।
তার অভিযোগ শুনে অনেকেই হতবাক হয়েছিলেন। মাহমুদাবাদ তার আইনজীবীর মাধ্যমে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। কিন্তু রেনু ভাটিয়া তাতে সন্তুষ্ট হননি।
সংবাদ উপস্থাপক যখন ভাটিয়ার কাছে জানতে চান, ওই পোস্টে ঠিক কোন শব্দ বা বাক্যগুলো সেনা কর্মকর্তাদের অপমান করেছে, তিনি কোনো নির্দিষ্ট উদাহরণ দিতে পারেননি।
তারপরও তিনি জোর দিয়ে বলেন, তার অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে, তাই মাহমুদাবাদের পোস্টে কিছু একটা ভুল আছে। তার মতে, আপত্তিকর শব্দ খুঁজে বের করার দায়িত্ব পুলিশের, তার নয়।
এরপর মাহমুদাবাদের পোস্টগুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়। কিন্তু সেখানে কোনো আপত্তিকর বা অপমানজনক কিছু পাওয়া যায়নি।
বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মহিলা কমিশনের কার্যক্রমের নিন্দা জানান।
বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এক সদস্য হরিয়ানা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন। তিনি দাবি করেন, মাহমুদাবাদের লেখা তাকে এবং অন্যদের আহত করেছে।
পুলিশ অভিযোগটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে মাহমুদাবাদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা তৈরি, একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং নারীর শালীনতা হরণের মতো গুরুতর অভিযোগের মামলা করে। সঙ্গে সঙ্গেই তাকে গ্রেফতার করা হয়।
মাহমুদাবাদের আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টে তার মুক্তির আবেদন করেন। কিন্তু শুনানির আগে ২০০ জনের বেশি শিক্ষাবিদ একটি বিবৃতি দেন, যাতে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
তারা মাহমুদাবাদকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা, প্রতিষ্ঠানের সম্মান ক্ষুণ্ণ করা এবং নারী অধিকার খর্ব করার চেষ্টা করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। তারা তার পোস্টগুলোকে ‘ছদ্ম-শিক্ষাগত অনুসন্ধানের আবরণে ঢাকা নারীবিদ্বেষ’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
শুনানির সময় মাহমুদাবাদের আইনজীবী পোস্টগুলো পাঠ করে শোনান। আদালত এতে সন্দেহ প্রকাশ করে এবং ইঙ্গিত দেয় যে, তার কথার দ্বৈত অর্থ থাকতে পারে।
আদালত মন্তব্য করে, ‘বিশ্লেষণাত্মক মননশীলতার কেউ ভাষার গভীরতা বুঝতে পারবে… ব্যবহৃত শব্দগুলো নিরীহ মনে হলেও, তা অপ্রত্যাশিতভাবে অন্যদের প্রতি লক্ষ্য রাখতে পারে।’
এরপর সুপ্রিম কোর্ট তিনজন সিনিয়র পুলিশ অফিসারের সমন্বয়ে একটি এসআইটি গঠন করে, যারা ‘পোস্টগুলোতে ব্যবহৃত ভাষার জটিলতা বুঝতে পারবে’।
এভাবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, মাহমুদাবাদের কথাগুলো সরাসরি গ্রহণ করা যায় না।
তার বক্তব্যে আপাতদৃষ্টিতে ভালো কিছু মনে হলেও, এর গভীরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
আদালতের এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। তাদের প্রশ্ন, আদালত কি নিজে পোস্টগুলো পড়ে বিশ্লেষণ করতে পারতো না? নাকি আদালত কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে দ্বিধা বোধ করছে?
ইতিমধ্যে, মাহমুদাবাদের পরিবারের পটভূমি, ধর্মীয় পরিচয়, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক এবং বিদেশ ভ্রমণসহ বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মিডিয়াও মাহমুদাবাদকে ‘খলনায়ক’ হিসেবে চিত্রিত করতে ব্যস্ত।
তার আসল কথাগুলো প্রচারণার ধোঁয়ায় ঢেকে যাবে এবং হিন্দু সমাজে একজন ধূর্ত, ষড়যন্ত্রকারী মুসলিমের চিত্র তৈরি করা হবে।
মাহমুদাবাদ এসআইটির সামনে হাজির হয়েছেন। বিজেপির ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি) তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ঘোষণা দিয়েছে।
তারা অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তাকে বরখাস্ত করার দাবি জানাচ্ছে। বিজেপির মূল সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘও (আরএসএস) মাহমুদাবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
এই ঘটনার মাধ্যমে আমরা দেখছি, কীভাবে মিডিয়া, পুলিশ ও বিচার বিভাগের সহায়তায় বিজেপি-বিরোধী সমালোচকদের ‘শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
আশা করা যায়, পুলিশ কর্মকর্তারা কোনো রকম প্রভাবের কাছে নতি স্বীকার না করে মাহমুদাবাদের লেখাগুলো সংবিধানের আলোকে বিচার করবেন। একজন মুসলিমের লেখা – সহানুভূতি, বোঝাপড়া, ন্যায়বিচার, সাম্য এবং মর্যাদার আহ্বান জানায়।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা