মানসিক স্বাস্থ্য: বাবারাও কি সন্তানের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন?
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাবার মানসিক স্বাস্থ্য সরাসরিভাবে শিশুদের বিকাশে প্রভাব ফেলে। চিকিৎসা বিষয়ক জার্নাল ‘JAMA Pediatrics’-এ প্রকাশিত এই গবেষণায় পিতৃত্বকালীন সময়ে (গর্ভধারণ থেকে শিশুর জন্মের দুই বছর পর্যন্ত) বাবার মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে সন্তানের বিকাশের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গবেষণায় প্রধানত বাবারা মানসিক অবসাদে ভুগলে শিশুদের মধ্যে কিছু সমস্যা দেখা যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শিশুর জ্ঞানীয়, সামাজিক-আবেগিক, ভাষা এবং শারীরিক বিকাশে দুর্বলতা। গবেষণায় মানসিক অবসাদ বলতে বিষণ্ণতা (ডিপ্রেশন), উদ্বেগ (অ্যাংজাইটি) অথবা দুটির মিশ্রণকে বোঝানো হয়েছে।
গবেষকরা দেখেছেন, বাবারা যখন মানসিক চাপে থাকেন, বিশেষ করে শিশুর জন্মের প্রথম দুই বছরে, তখন শিশুদের উপর এর প্রভাব বেশি দেখা যায়। এই সময়ে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাবা-মায়ের সুস্থ মানসিক অবস্থা অত্যন্ত জরুরি। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, এই সময়কালে বাবারা প্রায়ই মানসিক অবসাদে ভোগেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ৮ শতাংশ পুরুষ এই সময়ে বিষণ্ণতায়, ১১ শতাংশ উদ্বেগে এবং ৬ থেকে ৯ শতাংশ অতিরিক্ত মানসিক চাপে থাকেন।
গবেষণার প্রধান লেখক, অস্ট্রেলিয়ার ডেকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সিড লাইফস্প্যান রিসার্চ সেন্টার’-এর সহযোগী অধ্যাপক ড. ডেলিসা হাচিনসন বলেন, “ফলাফলের ধারাবাহিকতা দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছি। পরিবারের ভালো ফলাফলের জন্য বাবার মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়াটা খুবই জরুরি।”
আগেও কিছু গবেষণায় বাবার মানসিক স্বাস্থ্য এবং শিশুদের বিকাশের মধ্যে সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। তবে সেই গবেষণাগুলো সীমিত ছিল। নতুন গবেষণায় সামাজিক-আবেগিক, অভিযোজন ক্ষমতা, জ্ঞানীয়, ভাষা, শারীরিক ও মোটর- এই ৬ ধরনের বিকাশে বাবার মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
শিশুদের সামাজিক-আবেগিক বিকাশের মধ্যে রয়েছে অন্যদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি করা, অন্যের উপকারে কাজ করা, সুস্থ সম্পর্ক বজায় রাখা এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা ইত্যাদি। অভিযোজন ক্ষমতা বলতে বোঝায় পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ও দৈনন্দিন চাহিদাগুলো পূরণ করার ক্ষমতা। জ্ঞানীয় বিকাশের মধ্যে রয়েছে মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, শেখা এবং পড়াশোনায় ভালো ফল করা। শারীরিক বিকাশের ক্ষেত্রে শিশুর জন্মকালীন ওজন, উচ্চতা এবং ঘুমের স্বাস্থ্য বিবেচনা করা হয়। মোটর দক্ষতা বলতে সূক্ষ্ম ও বৃহৎ পেশীগুলোর সঠিক ব্যবহারকে বোঝায়।
গবেষণায় ৮৪টি আগের গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যেখানে কয়েক হাজার বাবা ও শিশুর তথ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মানসিক স্বাস্থ্য গর্ভধারণ থেকে শুরু করে শিশুর জন্মের দুই বছর পর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা হয়। যেসব বাবার কোনো শারীরিক সমস্যা ছিল বা যারা কোনো ওষুধ সেবন করতেন, তাদের এই গবেষণা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাবার মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে অভিযোজন ক্ষমতা এবং মোটর দক্ষতার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। তবে সামাজিক-আবেগিক, জ্ঞানীয়, ভাষা এবং শারীরিক বিকাশের ক্ষেত্রে সামান্য থেকে মাঝারি ধরনের সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে শৈশবের প্রথম দিকে এর প্রভাব বেশি দেখা যায়। এছাড়া, জন্ম-পরবর্তী মানসিক চাপ, জন্ম-পূর্ববর্তী মানসিক চাপের চেয়ে শিশুদের উপর বেশি প্রভাব ফেলে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বাবার মানসিক অবস্থা সন্তানের সঙ্গে তার সম্পর্কের গভীরতা এবং মানসিক বন্ধনকে প্রভাবিত করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশুদের সুস্থ বিকাশে বাবা-মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের ভালো ফলাফলের জন্য সমাজের উচিত পরিবারগুলোকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করা, যেমন- অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সমাজে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, বাবারা যদি মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কোনো সমস্যায় ভোগেন, তবে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এছাড়া, কাউন্সেলিং এবং বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আলোচনা করেও মানসিক চাপ কমানো যেতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক এই গবেষণাটি পরিবার এবং শিশুদের সুস্থ বিকাশে বাবার গুরুত্বকে নতুন করে তুলে ধরেছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন