চিংগলো পাখির (Rufous-collared Sparrow) একটি হারিয়ে যাওয়া গান পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন বুয়েনস আয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। মানুষের তৈরি একটি রোবট ব্যবহার করে এই কাজটি করা হয়েছে, যা পাখিটিকে সেই পুরোনো গানটি শিখতে সাহায্য করেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি কেবল একটি পাখির গান পুনরুদ্ধার নয়, বরং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
দক্ষিণ আমেরিকার এই অঞ্চলের রুফাস-কলার্ড স্প্যারো বা চিংগলো পাখির গান সেখানকার অন্যতম পরিচিত শব্দ। হালকা বাদামী বা সাদাটে রঙের, কালো ছোপযুক্ত এই ছোট পাখিটির গান কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। গানের শুরুতে ২-৪টি সুর থাকে এবং শেষে থাকে একটি বিশেষ তান। প্রতিটি চিংগলো পরিবারের নিজস্ব একটি গান থাকে, যা তারা সারা জীবন ধরে গায়। কিন্তু এই গান শেখার একটি প্রক্রিয়া রয়েছে।
সাধারণত, বাচ্চা বয়সের চিংগলো পাখিগুলো তাদের বাবা-মার কাছ থেকে গান শেখে। কোনো কারণে যদি এই শেখার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়, যেমন—আবাসস্থল ধ্বংস, পাখির সংখ্যা কমে যাওয়া, অথবা বয়স্ক পাখির অনুপস্থিতি—তখন গানের ধারাটিও ভেঙে যেতে পারে। বুয়েনস আয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। তাঁরা ১৯৬০-এর দশকে হাতে লেখা একটি গানের স্বরলিপি থেকে হারিয়ে যাওয়া একটি গান পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করেন। এর জন্য তাঁরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নেন এবং একটি রোবট তৈরি করেন। এই রোবটটি সেই হারিয়ে যাওয়া গানটি শোনাতে পারত, যা শুনে তরুণ চিংগলো পাখিগুলো গানটি শিখতে পারতো।
বুয়েনস আয়ার্সের পেরেইরা ইরাওলা পার্কে বসবাস করা চিংগলো পাখিদের মধ্যে এই গানটি আবার ফিরিয়ে আনা হয়। পার্কটি প্রায় ২৫ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। গবেষক দলের প্রধান গ্যাব্রিয়েল মিন্ডলিন বলেন, “আমরা সাধারণত জীববৈচিত্র্য রক্ষার কথা ভাবি, কিন্তু এর সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিষয়ও জড়িত। এখানে, আমরা একটি বিলুপ্তপ্রায় গানকে আবার জনপ্রিয় করে তুলেছি। এটি প্রমাণ করে, প্রয়োজন অনুযায়ী একটি সম্পূর্ণ সংস্কৃতি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।”
চিংগলো পাখির গান শেখার প্রক্রিয়াটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি পুরুষ চিংগলো পাখির গান তার প্রজাতি এবং পরিবারের একটি বিশেষ পরিচয় বহন করে। এই গানটি স্ত্রী পাখিকে আকৃষ্ট করতে এবং নিজের এলাকা চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। গান শেখার এই প্রক্রিয়া জন্মগ্রহণের পর প্রায় তিন মাস সময় নেয়। প্রথমে, তাদের কণ্ঠনালীর পেশীগুলোর নিয়ন্ত্রণ তেমন সুসংহত থাকে না, কিন্তু ধীরে ধীরে তারা একটি পরিমার্জিত শব্দ তৈরি করতে সক্ষম হয়।
গবেষকরা জানান, ১৯৬৫ সালে আর্জেন্টিনার পক্ষীবিদ ফার্নান্দো নটebোhm হাতে লিখে কিছু গানের স্বরলিপি তৈরি করেছিলেন। গবেষকরা সেই স্বরলিপি ব্যবহার করে পাখির গানের হারিয়ে যাওয়া সুরগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। তাঁরা জানতে পারেন, ১৯৬০-এর দশকে পেরেইরা ইরাওলা পার্কে যে গানগুলো শোনা যেত, তার মধ্যে কয়েকটি এখনো গাওয়া হয়। এই অঞ্চলের নগরায়ন এবং অন্যান্য পাখির আগমন, সম্ভবত এর কারণ হতে পারে। এরপর বিজ্ঞানীরা পাখির গানের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, যেমন— প্রতিটি সুরের শুরু এবং শেষের কম্পাঙ্ক, সময়কাল ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে একটি গাণিতিক মডেল তৈরি করেন। এই মডেল ব্যবহার করে পাখির কণ্ঠনালীর গঠন, শ্বাসনালী, মুখগহ্বর এবং ঠোঁটের ভৌত বৈশিষ্ট্যগুলি অনুকরণ করে গানের কৃত্রিম সংস্করণ তৈরি করা হয়।
এই কৃত্রিম গানটি অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে, অর্থাৎ যখন তরুণ পাখিরা তাদের গান শেখে, তখন তাদের শোনানো হয়। গান শোনানোর সময়কাল ছিল দিনের প্রথমভাগে, যখন পাখিরা সবচেয়ে বেশি গান গায়। বিজ্ঞানীরা গানের মধ্যে বিরতি এমনভাবে নির্ধারণ করেন, যেন পাখিরা এটিকে একটি স্বাভাবিক কথোপকথন হিসেবে অনুভব করতে পারে। এই পদ্ধতিতে, তরুণ চিংগলো পাখিরা হারিয়ে যাওয়া গানটি শিখে তাদের নিজস্ব গানে অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করে। গবেষকদের মতে, এই গবেষণা বন্য পাখিদের কণ্ঠের ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক