মাউন্ট ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতে কি মানুষের মস্তিষ্ক কাঁচ হয়ে গিয়েছিল? বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক
প্রাচীন ইতালির হারকিউলেনিয়াম শহরে ৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভিসুভিয়াস পর্বতের ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাতে সবকিছু ছাই হয়ে গিয়েছিল। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল একটি কঙ্কাল, যার মাথার খুলির ভেতরে ছিল কাঁচের মতো দেখতে একটি বস্তু। প্রথম দিকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিলেন, এটি সম্ভবত অগ্ন্যুৎপাতের ফলে মানুষের মস্তিষ্ক কাঁচের মতো শক্ত রূপ ধারণ করেছে। কিন্তু এই বিষয়ে এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের মধ্যে চলছে চরম বিতর্ক।
সম্প্রতি ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় হারকিউলেনিয়ামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া অতি উষ্ণ ছাইয়ের মেঘের কারণে মস্তিষ্কের টিস্যু কাঁচের মতো হয়ে যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই ছাইয়ের মেঘের কারণে দ্রুত তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও হ্রাসের ফলেই এমনটা ঘটা সম্ভব হয়েছে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, তাঁরা কাঁচের মতো পদার্থের মধ্যে স্নায়ু কোষের (নিউরন) মতো ক্ষুদ্র গঠন খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের দাবি, এই গঠন মস্তিষ্কের টিস্যু থেকে তৈরি হওয়ার প্রমাণ। ইতালির ইউনিভার্সিটà রোমা ট্রে-এর একজন ভলক্যানোলজিস্ট আলেসান্দ্রা পেনসা বলেছেন, “প্রাচীন মস্তিষ্কের অণুবীক্ষণিক স্নায়ু কাঠামো (নিউরাল স্ট্রাকচার) কাঁচের মতো অবস্থায় সংরক্ষিত থাকতে দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছি।
তবে, অনেক বিশেষজ্ঞ এই দাবির সঙ্গে একমত নন। তাঁদের মতে, অগ্ন্যুৎপাতের ফলে মস্তিষ্কের টিস্যু কাঁচের মতো হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাঁদের প্রশ্ন, এত উচ্চ তাপমাত্রায় মস্তিষ্কের মতো নরম টিস্যু কীভাবে টিকে থাকতে পারে? তাছাড়া, কাঁচ তৈরি হওয়ার জন্য যে দ্রুত তাপমাত্রা পরিবর্তনের প্রয়োজন, ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতে কি সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাঁচের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ৯৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (প্রায় ৫০৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করার পরেই এটি নরম হতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ছাইয়ের মেঘের তাপমাত্রা অন্তত এত বেশি ছিল।
কিন্তু অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ফরেনসিক নৃতত্ত্ববিদ অ্যালেক্সান্ড্রা মর্টন-হেইওয়ার্ডের মতে, “জীবন্ত টিস্যু স্বাভাবিক তাপমাত্রায় স্থিতিশীল কাঁচ তৈরি করতে পারে না। বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণায় বলছেন, এমন ঘটনার উদাহরণ পৃথিবীতে নেই। আমি মনে করি না, এটি এই নিয়মের ব্যতিক্রম।
অন্য বিজ্ঞানীরাও এই গবেষণার বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের মতে, কাঁচের মতো পদার্থের মধ্যে যে গঠনগুলো নিউরনের মতো দেখা যাচ্ছে, তা আসলে নিউরন কিনা, তা নিশ্চিত নয়। তাছাড়া, মস্তিষ্কের টিস্যুতে যে সাত ধরনের প্রোটিনের সন্ধান পাওয়া গেছে, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। কারণ, সাধারণত এত বেশি তাপমাত্রায় প্রোটিনগুলো ভেঙে যায়।
ইউনিভার্সিটà রোমা ট্রে-এর ভলক্যানোলজিস্ট গুইডো জিয়োরদানো বলেন, “আমরা একটি মানুষের খুলির ভেতরে কাঁচের মতো হওয়া মস্তিষ্কের গঠন এবং তার সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ পরিস্থিতি আবিষ্কার করেছি।
এই আবিষ্কার প্রত্নতত্ত্বের গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তবে, বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে আরও বেশি তথ্য-উপাত্ত বিনিময় করা প্রয়োজন। বিশেষ করে, কাঁচের মতো পদার্থের রাসায়নিক বিশ্লেষণ এবং প্রোটিনের বিশ্লেষণ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা উচিত, যাতে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা তাঁদের দাবির সত্যতা যাচাই করতে পারেন।
আর্কাইভগুলিতে সংরক্ষিত ডেটার অভাবের কারণে প্রত্নতত্ত্বের গবেষণা প্রায়শই বিতর্কের জন্ম দেয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভবিষ্যতে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় আরও স্বচ্ছতা আনা উচিত, যাতে এই ধরনের বিতর্ক এড়ানো যায়।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক