যুদ্ধাহত আফ্রিকা: এক একটি সমাধির খোঁজে বিশ্বযুদ্ধের হারানো সৈনিকদের স্মৃতিচারণ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (World War I) ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হয়ে যুদ্ধ করা আফ্রিকান সৈন্যদের অনেকেরই কোনো স্মৃতিচিহ্ন আজও পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈন্যদের স্মৃতিচিহ্ন রাখা হলেও, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈন্যদের কথা যেন কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। কেনিয়ার নাগরিক প্যাট্রিক আবুনগু এমনই একদল মানুষের কথা বলছেন, যাঁরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতি রক্ষার জন্য লড়ছেন।
প্যাট্রিক আবুনগু বর্তমানে কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশনের (Commonwealth War Graves Commission – CWGC) ঐতিহ্য ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর প্রধান কাজ হলো, বিশ্বযুদ্ধগুলোতে নিহত সৈন্যদের স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে বের করা এবং তাঁদের প্রতি সম্মান জানানো। ব্রিটিশ বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করা সৈন্যদের মধ্যে ইউরোপীয় সৈন্যদের সমাধিস্থল চিহ্নিত করা হলেও, আফ্রিকান সৈন্যদের সমাধির কোনো খোঁজ রাখা হয়নি।
আবুনগুর পরিবারের গল্পটা বেশ মর্মস্পর্শী। তাঁর প্রপিতামহ ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একজন সৈনিক, যাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরিবারের সদস্যরা আজও জানেন না, তিনি কোথায় এবং কীভাবে মারা গিয়েছিলেন। আবুনগু ছোটবেলা থেকেই তাঁর দাদার কাছে এই গল্প শুনে বড় হয়েছেন। সেই থেকেই তিনি তাঁর পরিবারের হারানো সদস্যের স্মৃতি খুঁজে বের করতে চান।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে কেনিয়াসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে সৈন্যদের জোর করে যুদ্ধে পাঠানো হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৫০ হাজার আফ্রিকান সৈন্য এবং ১০ লক্ষের বেশি সাহায্যকারীকে (carrier/porter) ব্যবহার করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে অনেকেরই মৃত্যুর পর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ১০ হাজারের বেশি আফ্রিকান সৈন্য নিহত হয়েছিলেন, যদিও তাঁদের স্মৃতিচিহ্ন রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
বর্তমানে, আবুনগুর নেতৃত্বে একটি দল কেনিয়ার বিভিন্ন স্থানে সৈন্যদের সমাধিস্থল খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। তাঁদের অনুসন্ধানের মূল লক্ষ্য হলো, সেই সব সৈন্যদের চিহ্নিত করা, যাঁদের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। এই কাজটি সহজ নয়। সমাধিস্থলগুলো খুঁজে বের করা, সেখানকার নথিপত্র সংগ্রহ করা এবং স্থানীয়দের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা—সবকিছুই সময়সাপেক্ষ ও কঠিন।
কেনিয়ার নাকুরু শহরে (Nakuru) একটি ধাতব কর্মশালায় (metalworking yard) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈন্যদের ১৭টি কবর খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই সমাধিস্থলগুলো একসময় পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছিল। আবুনগুর দল মনে করে, কর্মশালার নিচে হয়তো সেই কবরগুলো রয়েছে।
আফ্রিকার সৈন্যদের স্মৃতি রক্ষার এই সংগ্রাম শুধু একটি পরিবারের নয়, বরং পুরো মহাদেশের মানুষের আত্মমর্যাদার লড়াই। আবুনগু ও তাঁর দলের সদস্যরা চান, তাঁদের পূর্বপুরুষদের আত্মত্যাগের কথা সবাই জানুক এবং তাঁদের প্রতি যথাযথ সম্মান জানানো হোক। এই কাজটি একদিকে যেমন কঠিন, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর মাধ্যমে একদিকে যেমন অতীতের ভুলগুলো শুধরানো যাবে, তেমনই ভবিষ্যতের জন্য একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করা সম্ভব হবে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা