সাইপ্রাসের ঐতিহ্যবাহী ‘ commandaria’ ওয়াইনের পুনর্জন্মের চেষ্টা
ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত দ্বীপরাষ্ট্র সাইপ্রাস। এই দেশের ‘কমান্ডারিয়া’ নামের ওয়াইন প্রায় ৩০০০ বছর পুরনো, যা বিশ্বের প্রাচীনতম ‘নামকরণকৃত’ ওয়াইন হিসেবে পরিচিত। প্রাচীন গ্রিক কবি হোমার এবং নাট্যকার ইউরিপিদিস-এর লেখায় এই ওয়াইনের গুণাগুণ এর প্রশংসা পাওয়া যায়। এত সুদীর্ঘ ইতিহাস সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের জায়গা খুঁজে নিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে এই মিষ্টি ওয়াইনটিকে। তবে, বর্তমানে দেশটির কিছু ক্ষুদ্র ওয়াইন উৎপাদনকারী ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি পুনরায় অবলম্বন করে ‘কমান্ডারিয়া’ ওয়াইনকে বিশ্ব দরবারে পুনরায় পরিচিত করার চেষ্টা করছেন।
ঐতিহ্যপূর্ণ এই ওয়াইনের রয়েছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। প্রচলিত আছে, ত্রয়োদশ শতকে ফরাসি রাজা ফিলিপ অগাস্টাসের শাসনামলে অনুষ্ঠিত প্রথম ওয়াইন প্রতিযোগিতায় ‘কমান্ডারিয়া’ জয়লাভ করেছিল। ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট ১১৯১ সালে সাইপ্রাসে তার বিয়েতে অতিথিদের এই ওয়াইন পরিবেশন করেছিলেন। চতুর্দশ শতকে লন্ডনের মেয়র হেনরি পিকার্ড নাকি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্কটল্যান্ড, ডেনমার্ক ও সাইপ্রাসের নেতাদের এক ভোজসভায় এই ওয়াইনের আয়োজন করেছিলেন।
প্রাচীনকালে এই ওয়াইন ‘নামা’ নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে মধ্যযুগীয় নাইট টেম্পলাররা তাদের প্রধান কেন্দ্র স্থাপন করার পর এর নামকরণ করেন ‘কমান্ডারিয়া’। বাইজেন্টাইন আমলে দ্বীপের অর্থোডক্স চার্চ এই ওয়াইনকে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা শুরু করে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে ভেনিসের শাসনামলে এর উৎপাদন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। সেই সময় এর মিষ্টি স্বাদ এবং বিশেষ সুগন্ধের জন্য এর বেশ কদর ছিল।
বর্তমানে এক বোতল ‘কমান্ডারিয়া’ ওয়াইন প্রায় ২০ ইউরো থেকে ১৫০ ইউরো পর্যন্ত বিক্রি হয়। সাইপ্রাসের জুপিগি গ্রামের কমিউনিটি লিডার ক্রিস্টাকিস নিকোলাউ জানান, এই ওয়াইনের মধুময় স্বাদ, কিশমিশ, আখরোট, ডুমুর, ক্যারব, দারুচিনি, কফি ও ক্যারামেলের মতো স্বাদ-বৈশিষ্ট্যের কারণ হলো এখানকার আগ্নেয়গিরির মাটি।
সাইপ্রাসের কৃষি ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পানীয় পরিদর্শক সাভভাস কনস্টান্টিনোর মতে, চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বছরে প্রায় ২ লক্ষ বোতল ‘কমান্ডারিয়া’ ওয়াইন উৎপাদিত হয়েছে। এর একটি কারণ হলো, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার প্রায় ৮ লক্ষ পর্যটকের সাইপ্রাস ভ্রমণ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
প্রায় পাঁচ বছর আগে বিশাল চীনা বাজারে প্রবেশের চেষ্টা করা হলেও, চাহিদা পূরণ করতে না পারায় সেই পরিকল্পনা সফল হয়নি।
বিশিষ্ট ওয়াইন বিশেষজ্ঞ ডেমট্রি ওয়াল্টারস-এর মতে, পর্যাপ্ত বিপণনের অভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে ‘কমান্ডারিয়া’ উল্লেখযোগ্যভাবে পরিচিতি লাভ করতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ, দেশটির প্রধান ওয়াইন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান KEO-এর পুরনো ওয়াইনগুলোর সম্ভাবনা সম্পর্কে ধারণা করতে কিছুটা সময় লেগেছে। ডেমট্রি ওয়াল্টারস আরও বলেন, “দুঃখের বিষয় হলো, তাদের ‘কমান্ডারিয়া’ ওয়াইন খুবই ভালো মানের। এর অনন্য ইতিহাস, অসাধারণ গুণমান এবং অর্থের সঠিক মূল্য—যারা প্রথমবার এই ওয়াইন পান করেন, তারা এর স্বাদ ও জটিলতায় মুগ্ধ হন।”
ওয়াল্টারস আরও জানান, বিশেষ কিছু বাজার ছাড়া মিষ্টি ওয়াইন এখন তেমন একটা জনপ্রিয় নয়, তবে ‘কমান্ডারিয়া’র ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। সম্প্রতি এটি যুক্তরাজ্যের বাজারে প্রবেশ করেছে, তবে সীমিত পরিসরে।
আয়োস মামাস গ্রামের রেভেক্কা-র মতো কিছু ওয়াইনারি অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৫ সালে চালু হওয়ার পর থেকে তাদের বিক্রি ক্রমাগত বাড়ছে। গত বছর তাদের ‘কমান্ডারিয়া’ ওয়াইন জাতীয় ওয়াইন প্রতিযোগিতায় শীর্ষ স্থান অধিকার করেছে। এই ওয়াইনারিতে তিনজন কর্মী কাজ করেন এবং বছরে ৩,০০০ বোতল ওয়াইন উৎপাদিত হয়।
ওয়াইনারির তত্ত্বাবধায়ক নিকোলাস ক্রিস্টোডোলাইডস জানান, তারা ক্রেতাদের রুচি অনুযায়ী বিশেষ ধরনের ওয়াইন তৈরির চেষ্টা করছেন। তিনি আরও বলেন, “আমরা উৎপাদনের পরিমাণের চেয়ে গুণগত মানের ওপর বেশি জোর দিচ্ছি।” তাদের এই পদ্ধতি সফল হয়েছে, বিশেষ করে এক ইসরায়েলি দম্পতির জন্য, যারা শুধুমাত্র তাদের ওয়াইনের সংগ্রহ পুনরায় পূরণ করার জন্য সাইপ্রাসে আসেন।
‘কমান্ডারিয়া’ ওয়াইন তৈরি হয় সাইপ্রাসের স্থানীয় ‘মাভ্রো’ ও ‘জিনিস্টেরি’ আঙুর থেকে। এই আঙুরগুলো সংগ্রহের পর ৭ থেকে ১২ দিন সূর্যের আলোতে শুকানো হয়, যা ওয়াইনটিকে বিশেষ মিষ্টি স্বাদ প্রদান করে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সুরক্ষা নির্দেশিকা অনুযায়ী, এই ওয়াইন কমপক্ষে দুই বছর ধরে পুরনো ওক কাঠের পিপেতে সংরক্ষণ করা হয়। খাঁটি ‘কমান্ডারিয়া’ ওয়াইন শুধুমাত্র ট্রোডোস পর্বতশ্রেণীর দক্ষিণ দিকের ১৪টি গ্রামে উৎপাদিত হয়, যেখানে সারাদিন পর্যাপ্ত সূর্যের আলো থাকে।
কিছু ওয়াইনারি ‘মাভ্রো’ আঙুর থেকে গাঢ় এবং আরও মিষ্টি সংস্করণ তৈরি করে। ডোরোস গ্রামের কারসেরাস ওয়াইনারি এই ধরনের ওয়াইন তৈরি করে, যেখানে বছরে প্রায় ৪০ টন ওয়াইন উৎপাদিত হয়। সেখানকার ব্যবস্থাপক ফিলিপ্পোস কারসেরাস অভ্যন্তরীণ বাজারে এর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎসাহী, যদিও রাশিয়ার বাজার হারানোর ক্ষতি এখনো পূরণ হয়নি।
রেভেক্কা ওয়াইনারির উদ্যোক্তারা বিশ্বাস করেন, ছোট ওয়াইনারিগুলো ধীরে ধীরে ভোক্তাদের মন জয় করতে পারবে। ক্রিস্টোডোলাইডস বলেন, “আমরা প্রথমে আমাদের পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করব এবং অভ্যন্তরীণ বাজার জয় করব, এরপর সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে ‘কমান্ডারিয়া’র বাজার তৈরি করার চেষ্টা করব।”
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস