সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, অল্প সময়ের প্রশিক্ষণ মানুষকে অনলাইনে ভুল তথ্য বা ‘মিথ্যা খবর’-এর মোকাবিলা করতে সাহায্য করতে পারে। বিশেষ করে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভুয়া খবর থেকে বাঁচতে এই প্রশিক্ষণ বেশ কার্যকর। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. র্যাকোন মার্টেনস-এর নেতৃত্বে হওয়া এই গবেষণাটি সম্প্রতি ‘নেচার কমিউনিকেশনস’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণায় অংশ নেওয়া ১১,০০০ জনের বেশি মানুষকে তিনটি ভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণে অংশ নিতে বলা হয়। প্রথম পদ্ধতিতে, অংশগ্রহণকারীদের একটি ছোট নিবন্ধ পড়তে দেওয়া হয়, যেখানে ভুল তথ্য শনাক্ত করার কৌশলগুলো তুলে ধরা হয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে, একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও দেখানো হয়, যেখানে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর সাধারণ পদ্ধতিগুলো ব্যাখ্যা করা হয়। তৃতীয় পদ্ধতিতে, অংশগ্রহণকারীদের একটি খেলার মাধ্যমে মিথ্যা খবর তৈরি করতে উৎসাহিত করা হয়, যার ফলে তারা বুঝতে পারে কীভাবে ভুল তথ্য তৈরি ও প্রচার করা হয়।
গবেষকরা শুধু প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু মনে রাখার ক্ষমতা নয়, বরং মিথ্যা তথ্য চিহ্নিত করার দক্ষতা এবং এই ধরনের তথ্যের বিরুদ্ধে নিজেদের সুরক্ষিত রাখার আগ্রহ—এই বিষয়গুলোও পরিমাপ করেছেন। পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, প্রশিক্ষণ পাওয়া ব্যক্তিরা, প্রশিক্ষণ না পাওয়া ব্যক্তিদের চেয়ে ভালো ফল করেছেন। নিবন্ধ পড়ার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নেওয়া ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি সময় ধরে (প্রায় এক মাস) ভালো ফল করেছেন, যেখানে ভিডিও বা খেলার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নেওয়াদের ক্ষেত্রে এই প্রভাব দুই সপ্তাহ পর্যন্ত ছিল। তবে, গবেষকরা মনে করেন, মিথ্যা তথ্যের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষমতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যারা মিথ্যা তথ্য থেকে নিজেদের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মনে করেন, তারা প্রশিক্ষণে আরও বেশি মনোযোগ দিয়েছেন এবং বিষয়গুলো মনে রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, শেখা বিষয়গুলো মনে রাখতে এবং ভুয়া খবর প্রত্যাখ্যান করতে মাঝে মাঝে ‘অনুস্মারক’ বা ‘বুস্টার’ হিসেবে প্রশিক্ষণের বিষয়গুলো মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি।
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. এরিক নিসবেট এই গবেষণায় জড়িত না থাকলেও তিনি এই বিষয়ে তার মতামত দিয়েছেন। তিনি বলেন, “স্মৃতি এবং আগ্রহ—এই দুটি বিষয় একসঙ্গে থাকলে আমরা সেই জিনিসগুলো বেশি মনে রাখি, যা আমাদের মধ্যে শক্তিশালী আবেগ তৈরি করে।”
গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে ভুল তথ্য থেকে বাঁচানোর উপায় নিয়ে গবেষণা করছেন। এই গবেষণায় ‘প্রি-বঙ্কিং’-এর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ‘প্রি-বঙ্কিং’ হলো, মিথ্যা তথ্যের শিকার হওয়ার আগেই মানুষকে প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত করা। এর মাধ্যমে, মিথ্যা তথ্যের প্রভাব থেকে ব্যক্তি নিজেকে রক্ষা করতে পারে।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারী সকল ধরনের মানুষের ওপরই এই প্রশিক্ষণ কার্যকর হয়েছে। গবেষকদের মতে, প্রশিক্ষণের ফল কতদিন পর্যন্ত বজায় থাকবে, তা নির্ভর করে প্রশিক্ষণের বিষয়গুলো মানুষের মনে রাখার ক্ষমতার ওপর। প্রাথমিক প্রশিক্ষণের এক সপ্তাহ পর যদি একটি ‘অনুস্মারক’ দেওয়া হয়, তাহলে মিথ্যা তথ্য শনাক্ত করার ক্ষমতা এক মাস পর্যন্ত থাকতে পারে। আর, চার সপ্তাহ পর আরেকটি ‘অনুস্মারক’ দিলে এই প্রভাব আরও কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। ড. মার্টেনস মনে করেন, যদি তিন থেকে পাঁচবার ‘অনুস্মারক’ দেওয়া যায়, তাহলে এর কার্যকারিতা এক বছর বা তার বেশি সময় পর্যন্ত থাকতে পারে।
তবে, ড. নিসবেট সতর্ক করে বলেন, জাতীয় পর্যায়ে এই গবেষণা খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। কারণ, অনেক দেশে এ ধরনের কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সমর্থন বা অর্থ নেই। তিনি আরও পরামর্শ দেন, অনলাইনে কোনো খবর পড়ার সময় তাড়াহুড়ো না করে, ভালোভাবে যাচাই করে তবেই প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত। এছাড়া, যারা মিথ্যা তথ্য ছড়ায়, তাদের মূল লক্ষ্য হলো—অস্থিরতা তৈরি করা এবং বিভেদ সৃষ্টি করা। তাই, কোনো খবর পড়ার পর যদি আপনার মধ্যে রাগ বা বিরক্তি তৈরি হয়, তবে সেই বিষয়ে অন্যদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলতে পারেন।
তথ্য সূত্র: সিএনএন