নতুন দিগন্ত: জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার, গভীর সমুদ্রের শৈবাল বন ও মানব বসতি স্থাপনের যোগসূত্র
সমুদ্রের গভীরে, সূর্যের আলো যেখানে পৌঁছায় না, সেখানে এক অত্যাশ্চর্য জগৎ বিদ্যমান। একে বলা হয় শৈবাল বন বা “কেল্প ফরেস্ট”। এই বনগুলো শুধু এক একটি বাস্তুতন্ত্রই নয়, বরং পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সম্প্রতি, বিজ্ঞানীরা এই বনগুলোর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে নতুন করে গবেষণা করছেন। তাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য – এই বনগুলি হয়তো মানবজাতির আদি বসতি স্থাপনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
আজ থেকে প্রায় ২০,০০০ বছর আগে, শেষ বরফ যুগের সময়, একদল মানুষ সমুদ্রপথে এশিয়া থেকে উত্তর দিকে যাত্রা করে বেরিং প্রণালী পাড়ি দিয়ে আলাস্কা ও কানাডার মাঝে অবস্থিত বেরিঙ্গিয়া অঞ্চলে প্রবেশ করে। এরপর তারা দ্রুত মহাদেশের দক্ষিণে, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই দ্রুত বিস্তারের পেছনে ছিল কেল্প ফরেস্ট বা শৈবাল বন। কেল্প বনগুলি ছিল তাদের জন্য নির্ভরযোগ্য খাদ্য ও আশ্রয়ের উৎস।
“কেল্প হাইওয়ে” তত্ত্বটি এখন “ক্লোভিস তত্ত্ব”-এর চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। ক্লোভিস তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষ বেরিং স্থলপথ অতিক্রম করে আমেরিকায় এসেছিল। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে, মানুষ সম্ভবত উপকূল ধরে কেল্প বনগুলির কাছাকাছি পথ বেছে নিয়েছিল। আলাস্কা থেকে শুরু করে বাজা ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এই বনগুলোতে মাছ, শামুক, ঝিনুক এবং সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রাচুর্য ছিল, যা তাদের সারা বছর খাদ্যের যোগান দিয়েছে। কেল্প বা শৈবাল নিজেও খাওয়া যেত, আর এর শক্ত কাণ্ড দিয়ে তৈরি করা যেত মাছ ধরার সরঞ্জাম ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস।
কেল্প আসলে এক ধরনের বৃহৎ বাদামী শৈবাল, যা দেখতে অনেকটা গাছের মতো। প্রবাল প্রাচীরের পরেই, কেল্প বন পৃথিবীর সবচেয়ে উৎপাদনশীল সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি হাজারো প্রজাতির জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল। কেল্প খুব দ্রুত বাড়ে, দিনে প্রায় ৪৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এটি পানির নিচে একটি ত্রিমাত্রিক জগৎ তৈরি করে, যা বিভিন্ন ধরনের জীবের জন্য আশ্রয়স্থল তৈরি করে।
মেক্সিকোর সমুদ্র জীববিজ্ঞানী রদ্রিগো বিয়াসের মতে, কেল্প বনের মতো সুন্দর দৃশ্য আর হয় না। তিনি জানান, “প্রথমবার যখন কেল্প বন দেখি, তখন মনে হয়েছিল, ‘ওহ, বনেও কি ওড়া যায়?” শৈবাল বনের এই জটিল বাস্তুতন্ত্রে ক্ষুদ্র শৈবাল থেকে শুরু করে সামুদ্রিক প্রাণী, যেমন – তারা মাছ, রকফিশ, সি-লায়ন, হাঙর এমনকি তিমি পর্যন্ত বসবাস করে।
বিয়াস ব্যাখ্যা করেন, “কেল্প বনগুলি বিভিন্ন ধরনের সম্পদ সরবরাহ করে, যার অনেক কিছুই মানুষ আহরণ করে থাকে। কিন্তু যখন কেল্প বন ধ্বংস হয়ে যায়, তখন এর সঙ্গে জড়িত প্রজাতিগুলোও বিলুপ্ত হতে শুরু করে।”
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বিশ্বের অনেক কেল্প বন এখন নানা ধরনের ক্ষতির শিকার হচ্ছে। অতিরিক্ত মাছ ধরা, দূষণ, রোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই বনগুলো মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল, সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে “সি আর্চিন” বা “সামুদ্রিক অর্চিন”-এর সংখ্যা বৃদ্ধি।
কেল্প ঠাণ্ডা, পুষ্টিসমৃদ্ধ পানিতে ভালোভাবে জন্মে। সামান্য তাপমাত্রা বৃদ্ধিও এর সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে এবং এটি ধ্বংস হয়ে যায়। বিয়াসের মতে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে, তারা “৩৫৫ দিন ধরে সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধি” রেকর্ড করেছেন। এর ফলে মেক্সিকোর ওই অঞ্চলের কেল্প বনের প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে।
কেল্প দ্রুত বেড়ে উঠতে পারলেও, “সি আর্চিন”-এর কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। কেল্প বন যখন ভালোভাবে বেড়ে ওঠে, তখন “পার্পল সি আর্চিন” তুলনামূলকভাবে শান্ত থাকে এবং কেল্পের ধ্বংসাবশেষ খেয়ে বাঁচে। কিন্তু কেল্প বন ধ্বংস হয়ে গেলে, তারা আরও সক্রিয় ও আগ্রাসী হয়ে ওঠে। ফলে পুরো এলাকা “সি আর্চিন”-এ ভরে যায়। কেল্প বন বিলুপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে “সি আর্চিন”-কে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা সি-অটার, হাঙর, লবস্টার, কাঁকড়া ও মাছও কমতে শুরু করে।
এটি জলবায়ু পরিবর্তনের একটি স্পষ্ট উদাহরণ, যা একটি বাস্তুতন্ত্রের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং মানুষের জীবনযাত্রাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। জেলে সম্প্রদায়কে দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হচ্ছে, কারণ তাদের ঐতিহ্যবাহী মৎস্য শিকারের পদ্ধতিগুলো ব্যাহত হচ্ছে। কেল্প বনে বসবাসকারী অনেক অমেরুদণ্ডী প্রাণী ও মাছের অর্থনৈতিক মূল্য অনেক বেশি, তাই এই বাস্তুসংকটের কারণে মানুষের ক্ষতিও বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার লাল অ্যাবালোনের মৎস্য ব্যবসা, যা প্রতি বছর কোটি কোটি ডলারের, তা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কেল্প বন পুনরুদ্ধারের কোনো সহজ উপায় নেই, তবে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিছু স্বেচ্ছাসেবক ডুবুরি হাতুড়ি ও অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করে “সি আর্চিন” অপসারণ করছেন, যাতে কেল্প নতুন করে জন্মাতে পারে। এছাড়াও, বিজ্ঞানীরা এমন কেল্প প্রজাতি তৈরি করার চেষ্টা করছেন, যা উষ্ণতা সহ্য করতে পারবে।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক মূল্যের বাইরে, কেল্প বন জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি প্রচুর পরিমাণে কার্বন শোষণ করে এবং উপকূলকে ঝড় থেকে রক্ষা করে।
কেল্প প্রায় ২ কোটি ৩০ লক্ষ বছর ধরে টিকে আছে। এটি বরফ যুগ ও উষ্ণতা বৃদ্ধিকেও জয় করেছে এবং মানুষের বসতি স্থাপনে সহায়তা করেছে। একে ফিরিয়ে আনাটাও সেই আদি অভিবাসীদের মতো উদ্ভাবনী ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার দাবি রাখে।
কেল্প বন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র রক্ষার জন্য আমাদের এ বিষয়ে আরও ভালোভাবে জানতে হবে। প্রাদা গ্রুপ এবং ইউনেস্কো-আইওসি (UNESCO-IOC) “সিয়া বিয়ন্ড” (SEA BEYOND) নামক একটি শিক্ষামূলক কর্মসূচি চালু করেছে, যা সারা বিশ্বের স্কুলগুলোতে শিশুদের সমুদ্র সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক