ভ্রমণের পথে ভীতি? বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে আকাশ পথের উদ্বেগ জয় করুন!
বর্তমানে আন্তর্জাতিক ভ্রমণের চাহিদা বাড়ছে, এবং এর সাথে বাড়ছে উড়োজাহাজে ভ্রমণের প্রবণতা। অনেকেই হয়তো জানেন না, শুধু আমেরিকাতেই প্রায় আড়াই কোটি মানুষ উড়োজাহাজে চড়তে ভয় পান। এই ভীতি অনেক সময় ভ্রমণের পরিকল্পনাকে ব্যাহত করে, এমনকি প্রিয়জনদের সাথে আনন্দ ভ্রমণে যাওয়া থেকেও বিরত রাখে। তবে, ভয়ের এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। মনোবিজ্ঞানীরা কিছু কার্যকরী উপায় বাতলেছেন, যা অনুসরণ করে আপনিও আকাশ পথের উদ্বেগকে জয় করতে পারেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভয়ের মূল কারণ খুঁজে বের করা জরুরি। লাইসেন্সপ্রাপ্ত ক্লিনিক্যাল সোশ্যাল ওয়ার্কার জেনি মায়েনপা বলেন, “আকাশে ভ্রমণের ভয় একটি অস্বস্তিকর অনুভূতি। উড়ানের সময় শারীরিক অস্বস্তি ছাড়াও এই ভয়ের কারণে অনেক সময় লজ্জিত হতে হয়। অতীতের কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা, অস্থির উড়ান, এমনকি ছোটবেলার কোনো ভীতিজনক গল্পও এই উদ্বেগের কারণ হতে পারে। মনোবৈজ্ঞানিক থেরাপির মাধ্যমে গভীর অনুসন্ধানে এর আসল কারণ খুঁজে বের করা যেতে পারে।”
এই বিষয়ে মনোবিজ্ঞানী আব্রাহ স্প্রাং-এর পরামর্শ, “ধীরে ধীরে ভয়ের মুখোমুখি হওয়া এই সমস্যার সমাধানে সাহায্য করতে পারে। প্রথমে বিমানের উড্ডয়ন বিষয়ক ভিডিও দেখুন, এরপর বিমানবন্দরে যান, তবে উড়োজাহাজে না চড়ে। ধীরে ধীরে একটি ফ্লাইটে চড়ার চেষ্টা করুন।” তিনি আরও যোগ করেন, “ধাপে ধাপে ভয়ের মোকাবেলা করলে আপনার মস্তিষ্ক আতঙ্কের পরিবর্তে আত্মবিশ্বাসের সাথে সাড়া দিতে শিখবে।”
কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি বা সিবিটি (CBT) এক্ষেত্রে খুবই কার্যকর। মিশান কানেকশন-এর ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর অ্যাশলি পেনার মতে, “সিবিটি আপনাকে উড়োজাহাজ নিয়ে অযৌক্তিক ভয়গুলো চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। অনেক সময় আমরা পরিস্থিতিকে আরও খারাপভাবে কল্পনা করি, যেমন ‘বিমানটি বিধ্বস্ত হবে’ বা ‘আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ব’। সিবিটি এই ধরনের চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করে আরও বাস্তবসম্মত ধারণা তৈরি করতে সহায়তা করে।” এই থেরাপি অনলাইনেও করা সম্ভব।
উড়োজাহাজে উদ্বেগের সময় শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম খুবই কাজে আসে। আব্রাহ স্প্রাং-এর মতে, “চার সেকেন্ড ধরে শ্বাস নিন, চার সেকেন্ড ধরে রাখুন, চার সেকেন্ড ধরে শ্বাস ছাড়ুন এবং আবার চার সেকেন্ড ধরে শ্বাস বন্ধ করুন।” এই পদ্ধতি আপনার স্নায়ু শান্ত করতে এবং উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে।
এছাড়াও, “৫-৪-৩-২-১” নামক একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। অ্যাশলি পেনার পরামর্শ অনুযায়ী, “বিমানে থাকাকালীন সময়ে, পাঁচটি জিনিস দেখুন, চারটি জিনিস স্পর্শ করুন, তিনটি শব্দ শুনুন, দুটি গন্ধ অনুভব করুন এবং একটি স্বাদ গ্রহণ করুন।” এর ফলে মন বর্তমান সময়ে কেন্দ্রীভূত থাকে, যা ভয় কমাতে সহায়তা করে।
বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের অ্যাপ্লিকেশন পাওয়া যায়, যা ভ্রমণের চাপ কমাতে সাহায্য করে। “হেডস্পেস”-এর মতো মেডিটেশন ও রিলাক্সেশন অ্যাপগুলো এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। এই ধরনের অ্যাপ্লিকেশনগুলো ভ্রমণের সময় শোনা যেতে পারে, যা উদ্বেগমুক্ত রাখতে সাহায্য করবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কিছু বিষয় এড়িয়ে চলা ভালো। হিপনোথেরাপিস্ট ও সাইকোথেরাপিস্ট এরিন ওয়াইনস্টেইন-এর মতে, “দুর্ভাগ্যবশত, অ্যালকোহল বা চিনি উদ্বেগের সমাধান নয়।” ভ্রমণের আগে এগুলো গ্রহণ করলে সাময়িক আরাম পাওয়া গেলেও তা উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ, এগুলো রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় এবং অস্থিরতা অনুভব হয়।
হিপনোসিসও এক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে। এরিন ওয়াইনস্টেইন-এর মতে, “হিপনোসিস মানুষকে একটি ‘শান্ত বোতাম’ তৈরি করতে সাহায্য করে, যা মানসিক শান্তির জন্য সহায়ক।” ইউটিউবে গাইডেড হিপনোসিস শুনে অথবা ব্যক্তিগত সেশন বুক করে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে।
মনকে ব্যস্ত রাখাটাও গুরুত্বপূর্ণ। হেলদি লাইফ রিকভারি-র এক্সিকিউটিভ ক্লিনিক্যাল ম্যানেজার মিশেল ইংলিশ বলেন, “বই পড়া, গান শোনা অথবা সিনেমা দেখার মাধ্যমে মনকে বিক্ষিপ্ত রাখুন। অন্য কোনো বিষয়ে মনোযোগ দিলে ভয়ের কথা মনে আসার সম্ভাবনা কমে যায়। এটা একটা সহজ কৌশল, যা অনেকের জন্য কাজ করে।”
উড়োজাহাজের ক্রুদের সাথে কথা বলেও আপনি আপনার উদ্বেগকে কমাতে পারেন। ওহানা অ্যাডিকশন ট্রিটমেন্ট সেন্টার-এর ক্লিনিক্যাল সুপারভাইজার জে.এল. সার্ল বলেন, “তাদের সাথে কথা বললে উড়োজাহাজ বিষয়ক অনেক অজানা বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবেন, যা আপনার ভয় কমাতে সাহায্য করবে।”
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, উড়োজাহাজে ভ্রমণ যে অত্যন্ত নিরাপদ, সে বিষয়ে অবগত থাকা। আব্রাহ স্প্রাং-এর মতে, “বিমানগুলো শক্তিশালী এবং পাইলটরা সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রশিক্ষিত। সামান্য ঝাঁকুনি অনুভব হলেও, এটি রাস্তার ঝাঁকির মতোই, যা ভীতিকর হলেও বিপজ্জনক নয়।” পরিসংখ্যান অনুযায়ী, উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার সম্ভাবনা খুবই কম, যা গাড়ি চালানোর চেয়েও নিরাপদ। ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, উড়োজাহাজ এমনকি সরাসরি বজ্রপাতকেও প্রতিরোধ করতে পারে এবং বিমান দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় ৯৫ শতাংশের বেশি।
সুতরাং, ভয়কে জয় করে আত্মবিশ্বাসের সাথে ভ্রমণের জন্য প্রস্তুত হোন।
তথ্য সূত্র: ট্রাভেল অ্যান্ড লেজার