নওরোজ: পারস্যের নববর্ষ, বিশ্বজুড়ে উদযাপিত বসন্তের উৎসব
বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে নওরোজ। এটি পারস্য বর্ষের প্রথম দিন, যা সাধারণত ২১শে মার্চের আশেপাশে, অর্থাৎ বসন্ত বিষুবের সময় উদযাপিত হয়। এই উৎসব শুধু একটি দিনের উদযাপন নয়, বরং প্রায় ১৩ দিনের এক আনন্দ-উৎসব, যা প্রকৃতির নবজন্ম এবং অন্ধকারের বিদায়কে স্মরণ করিয়ে দেয়। ইরান, আজারবাইজান, আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে এই উৎসবের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এছাড়া, কুর্দি, তুর্কি উইঘুর এবং পার্সি সম্প্রদায়ের মানুষজনও বিশ্বজুড়ে নওরোজ পালন করে থাকেন।
নওরোজের ইতিহাস প্রায় ৩,০০০ বছরের পুরনো। জরাথুস্ট্রীয় ধর্ম থেকে এর উৎপত্তি। এই উৎসবের মূল ধারণা হলো, নতুন দিনের সূচনা এবং প্রকৃতির প্রতি সম্মান জানানো। জাতিসংঘের মতে, ২১শে মার্চ আন্তর্জাতিক নওরোজ দিবস হিসেবে স্বীকৃত।
নওরোজ উদযাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ঘর পরিষ্কার করা বা “খানে تکانی” (khane tekani)। উৎসবের আগে ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার মাধ্যমে নতুন বছরের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়। এই সময় বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাওয়া হয়, চলে শুভেচ্ছা বিনিময়। বিভিন্ন স্থানে উৎসব উপলক্ষে নানান ধরনের লোকনৃত্য ও গান পরিবেশিত হয়। খেলাধুলারও আয়োজন করা হয়।
নওরোজের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো খাদ্য-রীতি। এই উৎসবে নানা ধরনের সুস্বাদু খাবার তৈরি করা হয়। ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো “হাফত-সিন”। “হাফত-সিন” হলো এমন একটি টেবিল সজ্জা, যেখানে সাতটি বিশেষ উপাদান রাখা হয়, যেগুলোর প্রত্যেকটি ফার্সি ভাষায় ‘স’ অক্ষর দিয়ে শুরু হয়। এই সাতটি উপাদান বিভিন্ন প্রতীক বহন করে, যেমন স্বাস্থ্য (রসুন), ধৈর্য (ভিনেগার), সৌন্দর্য (আপেল) ইত্যাদি। এছাড়াও, সবুজ ঘাস বা “সাবজেহ”, শুকনো ফল, মিষ্টি এবং রঙিন ডিম দিয়ে এই টেবিল সাজানো হয়।
নওরোজের প্রধান খাদ্যগুলোর মধ্যে ইরানে “কুকু সবজি” (এক প্রকার ভেষজ অমলেট), “সবজি পোলো বা মাহি” (ভেষজ মিশ্রিত ভাত ও ভাজা মাছ) এবং “রেশতেহ পোলো” (বিশেষ চাল ও নুডলস) উল্লেখযোগ্য। উজবেকিস্তান ও আজারবাইজানের জাতীয় খাবার “পলো” বা পোলাও নওরোজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। মাংস, সবজি ও মশলার ভিন্নতা অনুসারে এই পলোর অনেক প্রকারভেদ দেখা যায়। আজারবাইজানে সুস্বাদু কাবাব ও “ডোলমা” (শাক দিয়ে মোড়ানো মাংস) এবং “বাকালাভা” ও “শেকরবুরা” (মিষ্টি) খুবই জনপ্রিয়। উজবেকিস্তানে “সুমালাক” নামে এক প্রকার মিষ্টি পুডিং তৈরি করা হয়। আফগানিস্তানে “সাবজি চালও” (পালং শাক ও মাংসের তরকারি) এবং “কোলচেহ নওরোজি” (চাল-আটার বিস্কুট) ও “হাফত মেওয়া” (ড্রাই ফ্রুট সালাদ) পরিবেশন করা হয়। কাজাখস্তানে “নওরুজ কোজে” (বার্লি, ঘোড়ার মাংস ও দুধ দিয়ে তৈরি স্যুপ) খাওয়ার রীতি প্রচলিত আছে।
নওরোজের উৎসব মূলত পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কাটানোর একটি উপলক্ষ। এটি নতুন আশা ও উদ্দীপনা নিয়ে আসে, যা মানুষকে একতাবদ্ধ করে। নওরোজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের বন্ধন আরও দৃঢ় করে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক