সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্ল্যাটফর্ম ‘এক্স’ (সাবেক টুইটার)-এর উত্থান ও বিবর্তনের এক বিস্ফোরক চিত্র নিয়ে আসছে সিএনএন-এর নতুন ধারাবাহিক ‘টুইটার: ব্রেকিং দ্য বার্ড’। আগামী ৯ই মার্চ থেকে শুরু হয়ে এই চার পর্বের ধারাবাহিকটি প্রতি রবিবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় প্রচারিত হবে। এতে প্ল্যাটফর্মটির নির্মাতা এবং এর সঙ্গে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মুখ থেকে শোনা যাবে এর ভেতরের গল্প।
২০০৬ সালে যাত্রা শুরু হয় টুইটারের। শুরুতে এর নির্মাতারা হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি, এই প্ল্যাটফর্মটি একদিন বিশ্বজুড়ে মানুষের যোগাযোগের ধরনটাই বদলে দেবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে যখন এর মালিকানা টেক জায়ান্ট ইলন মাস্কের হাতে আসে, তখন অনেক কিছুই ওলট-পালট হয়ে যায়।
ধারাবাহিকটিতে টুইটারের একেবারে শুরুর দিনগুলো তুলে ধরা হয়েছে। সেই সময়টা ছিল ইন্টারনেটের উন্মেষকাল। টুইটারের নির্মাতারা চেয়েছিলেন এমন একটি জগৎ তৈরি করতে যেখানে সবাই তাদের কথা বলতে পারবে। কিন্তু ধীরে ধীরে এই প্ল্যাটফর্ম ঘৃণা, বিদ্বেষ এবং ভুয়া তথ্যেরও বিস্তার ঘটাতে শুরু করে, যা তাদের ধারণার বাইরে ছিল।
টুইটারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইভান উইলিয়ামস এই বিষয়ে বলেন, “তখন এত দ্রুত সবকিছু ঘটছিল যে, আমরা এর বৃহত্তর প্রভাবগুলো নিয়ে গভীর ভাবে ভাবার সময় পাইনি।”
আজকের দিনে এসে আমরা জানি, টুইটার বা ‘এক্স’-এর পরিণতি কী হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক এখন এর মালিক। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছেন। এমনকি, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নির্বাচনে সাহায্য করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মাস্কের বিতর্কিত নীতিমালার কারণে বিজ্ঞাপনদাতারাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, যা কোম্পানিটির আর্থিক মূল্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
ধারাবাহিকটি জানাচ্ছে, কীভাবে এই পরিবর্তনগুলো এলো। এতে টুইটারের জন্ম থেকে শুরু করে এর নেতৃত্বের সংকট, রাজনৈতিক নেতাদের টুইট করা শেখা এবং সবশেষে মাস্কের ৪৪ বিলিয়ন ডলারে কোম্পানিটি কিনে নেওয়ার ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
উইলিয়ামস আরও বলেন, “আমরা এমন একটি জিনিস তৈরি করেছিলাম যা নিজের গতিতে চলতে শুরু করে এবং এর ভালো-মন্দ দুটো দিকই ছিল। ভালো দিকগুলো যেন খারাপের চেয়ে বেশি থাকে, সেই চেষ্টাটাই আমরা করছিলাম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে মনে হয়েছে, যেন আমরা হেরে যাচ্ছি। প্রশ্ন জাগে, এই ধারণাটা কি ভুল ছিল?”
টুইটারের প্রথম দিকের কর্মীদের অনেকেই মনে করেন, তাঁরা হয়তো তাঁদের তৈরি করা পণ্যটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সেভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। সে সময় ফেসবুক সবে যাত্রা শুরু করেছে, আর ব্লগিং ছিল বেশ জনপ্রিয়। এমনকি স্মার্টফোনও ছিল না।
টুইটারের প্রথম দিকের দিনগুলোতে ব্যবহারকারীরা হালকা বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। যেমন, প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসি লিখতেন, “বাড়ি যাচ্ছি। ঠান্ডা লাগছে।” আরেকজন লিখতেন, “আলু সেদ্ধ খাচ্ছি, সাথে সবুজ বিন আর বারবিকিউ সইতান ও সাদা ওয়াইন।”
টুইটারের প্রোডাক্ট বিভাগের প্রথম প্রধান জেসন গোল্ডম্যান বলেন, “আপনি হয়তো একটি ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেন, কিন্তু অনিশ্চয়তা অনেক বেশি থাকে। তাই প্রযুক্তি শিল্পে দ্রুত কিছু করার একটা প্রবণতা দেখা যায়। আমরা কিছু একটা তৈরি করি, চালু করি এবং দেখি মানুষ সেটা কীভাবে ব্যবহার করে।”
তবে, টুইটার যে শুধু খারাপ কাজেই ব্যবহৃত হয়েছে, তা নয়। আরব বসন্ত বা ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক আন্দোলনেও এই প্ল্যাটফর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, যা হয়তো নির্মাতারাও কল্পনা করেননি।
টুইটারের কেন্দ্রে ছিলেন জ্যাক ডরসি। তিনিই এই প্ল্যাটফর্মের মূল কারিগর হিসেবে পরিচিত। ডরসির চিন্তা ও আদর্শ টুইটারের ভিত্তি স্থাপন করেছে। তিনি সব সময় মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। ২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “একটি প্ল্যাটফর্মকে প্ল্যাটফর্ম হতে হলে সেখানে অবশ্যই মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে। আমাদের সব ধরনের চরম মতামত শুনতে হবে।”
কিন্তু এর ফলে অনেক সময় প্ল্যাটফর্মের সমস্যাগুলো সমাধানে তিনি ধীরগতি দেখিয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্ট অ্যান্ড সেফটির সাবেক প্রধান ডেল হার্ভে জানান, ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো বন্ধ করতে টুইটার তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
২০২০ সালে ডরসি, ইলন মাস্ককে কর্মীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ডরসি মাস্ককে সরাসরি প্রশ্ন করেন, “আপনি কি টুইটার চালাতে চান?”
জবাবে মাস্ক বলেন, কর্মীদের এমন সব মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, যারা প্ল্যাটফর্মটিকে “ব্যবহারকারীদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে”। এর দুই বছর পর, মাস্ক টুইটারে বিনিয়োগ করা শুরু করেন এবং অবশেষে ৪৪ বিলিয়ন ডলারে এটি কিনে নেন।
গোল্ডম্যান মনে করেন, টুইটারের শুরুতে আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেত, যাতে এর মূল লক্ষ্য বজায় রাখা যেত। তাঁর মতে, “আমরা চেয়েছিলাম এটি ভালো কাজে ব্যবহৃত হোক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কিছু ক্ষেত্রে এটি একটি প্রভাবশালী প্রচারের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে, ডানপন্থী, কর্তৃত্ববাদী মতাদর্শের প্রসারে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে, যা আদতে একটি উদ্বেগের বিষয়।”
তথ্যসূত্র: সিএনএন