গাজায় যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ায় সেখানকার মানুষজন নতুন করে ধ্বংসের শিকার, বাড়ছে মানবিক বিপর্যয়। গত দুই মাসের যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজায় মৃতের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
সেখানকার সাধারণ মানুষ, যাদের মধ্যে নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ এবং শিশু সবাই আছেন, তাদের চোখে-মুখে এখন চরম হতাশা আর আতঙ্ক। খবর আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর।
গাজার উপকূলীয় এলাকা আল-মাওয়াসির ৪০ বছর বয়সী একজন সাহায্য কর্মী ওসামা বলেন, “আমাদের আশা জেগেছিল, কিন্তু এখন আমরা আবার সেই আগের অবস্থানে ফিরে গেছি।” এই এলাকাটিকে প্রথমে মানবিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হলেও, বর্তমানে এটি অতিরিক্ত জনসমাগম এবং স্বাস্থ্যবিধির অভাবে জর্জরিত।
মঙ্গলবার ইসরায়েলের ভয়াবহ বিমান হামলায় চার শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়। স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, বুধবারের হামলায় আরও ২০ জন মারা গেছেন।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এক বিবৃতিতে জানান, সামরিক বাহিনী তাদের নতুন অভিযান আরও জোরদার করতে প্রস্তুত হচ্ছে। তিনি গাজার বাসিন্দাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “এটা শেষ সতর্কবার্তা। আপনারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পরামর্শ শুনুন।
জিম্মিদের ফেরত দিন এবং হামাসকে সরিয়ে নিন, তাহলে আপনাদের জন্য অন্যান্য বিকল্প খোলা হবে। আপনারা চাইলে বিশ্বের অন্য কোথাও যেতে পারেন।”
আল-মাওয়াসিতে যুদ্ধবিরতির সময় উপকূল জুড়ে তৈরি হওয়া তাঁবুর শিবিরগুলো খালি হয়ে গিয়েছিল। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি মেরামতের জন্য গাজার উত্তরে ফিরে গিয়েছিল।
কিন্তু এখন তারা আবার ফিরছে এবং বালুকাময় স্থানে পুনরায় তাঁবু স্থাপন করছে। ওসামা আরও বলেন, “সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো অভাব বা অনিশ্চয়তা নয়, বরং যুদ্ধবিরতির ফলে আমাদের যেটুকু আশা জেগেছিল, সেটিও এখন চলে গেছে।
আমরা ভেবেছিলাম আমাদের কষ্ট শেষ হয়েছে, কিন্তু এটা আবার নতুন করে শুরু হলো।”
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর নির্দেশে, মঙ্গলবার নতুন করে বিমান হামলা ও ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণের কারণে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে আবার অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় নিতে হচ্ছে। গত বছরও তারা সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল।
গাজার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত এক সময়ের সমৃদ্ধ শহর বাইত হানুন-এ ইসরায়েলি বাহিনী লিফলেট বিতরণ করে বাসিন্দাদের সতর্ক করে বলেছে, “আশ্রয়কেন্দ্রে বা বর্তমান তাঁবুতে থাকা আপনার এবং আপনার পরিবারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
তাই অবিলম্বে এলাকাটি ত্যাগ করুন।” রাফাহ এবং খান ইউনিসের কাছাকাছি শহরগুলোতেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। নতুন নির্দেশের ফলে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষকে ঘর ছাড়তে বলা হয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর দিকে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের জন্য কিছু নম্বরযুক্ত এলাকার ব্যবস্থা করেছিল, যেখানে তাদের জন্য তুলনামূলকভাবে নিরাপদ থাকার কথা ছিল। তবে বর্তমানে সেই ব্যবস্থাটি আর দেখা যাচ্ছে না।
গাজার অনেক মানুষ বলছেন, তারা এখন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে, যেখানে পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই, সেখানে টিকে থাকার জন্য প্রতিদিন সংগ্রাম করছেন।
রাফাহ-এর রেড ক্রস ফিল্ড হাসপাতালের কর্মীরা জানান, তারা প্রচুর সংখ্যক রোগী পাচ্ছেন। হাসপাতালের একজন সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার ফ্রেড ওলা বলেন, “এখন বাতাসে আতঙ্ক অনুভব করা যাচ্ছে, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন একটানা বাজছে এবং আমরা যাদের সাহায্য করছি, তাদের চোখেমুখে গভীর যন্ত্রণা দেখতে পাচ্ছি।
মানুষজন ভীত এবং তারা আবারও কেবল পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা বাঁচার কথা ভাবছে।”
যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ইসরায়েল গাজায় কঠোর অবরোধ পুনর্বহাল করে। জরুরি অবস্থার কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়।
এক কেজি আলুর দাম এখন প্রায় ৬০০ টাকার বেশি, যা এক সপ্তাহ আগের চেয়ে চারগুণ বেশি। একজন সাহায্য কর্মকর্তা বলেন, “অনেকের পক্ষেই এই দামে আলু কেনা সম্ভব নয়।
এছাড়াও, সেখানে কোনো তাজা ফল বা দুগ্ধজাত পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না, তা আপনি যত টাকাই খরচ করেন না কেন।”
সাহায্য সরবরাহও সীমিত করা হয়েছে। যদিও যুদ্ধবিরতির সময় প্রায় ২৫ হাজার ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছিল, তবুও সরবরাহ দ্রুত ফুরিয়ে যেতে পারে।
গাজার একজন সিনিয়র সাহায্য কর্মকর্তা বলেন, “আমাদের কাছে এক সপ্তাহের মতো আটা আছে, তবে এই মাসের জন্য সবার জন্য রেশন সরবরাহ করার মতো পর্যাপ্ত খাবার নেই।” আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি জানিয়েছে, তাদের কাছেও চিকিৎসা সামগ্রীর মজুত কমে আসছে।
গাজার প্রায় সবাই একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, প্রায়ই ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর নির্দেশে তাদের ঘর ছাড়তে হয়েছে। বাইত হানুন থেকে পরিবারের সঙ্গে আল-শাতি ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া ২৮ বছর বয়সী নার্স খতাম আল-কাফারনা বলেন, “আমরা নির্দেশে বিস্মিত হয়েছিলাম।
আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, কিছু খাবার সংগ্রহ করে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করি।” তিনি আরও বলেন, “বাস্তবতা কঠিন, পরিস্থিতিও খুবই খারাপ।
এখানে কোনো সাহায্য নেই, খাবার নেই, রুটি নেই, জল নেই, বিশ্রাম নেই, এমনকি ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলেও কিছু নেই।”
গাজার সাবরা এলাকার একটি বাড়ি ইসরায়েলি বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। আল-শাতি ক্যাম্পেও বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
সাহায্য সংস্থাগুলো এই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না, তাই তাদের কাছে প্রয়োজনীয় জিনিসেরও অভাব রয়েছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মঙ্গলবার এক ভাষণে বলেন, হামাস যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার কারণেই তিনি নতুন করে হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।
অন্যদিকে হামাস, যাদের হাতে এখনো প্রায় ২৫০ জন জিম্মির মধ্যে ৫৯ জন রয়েছে, তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের স্থায়ী সমাপ্তির জন্য তিন-পর্যায়ের যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ করেছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলায় নিহত হয়েছিল প্রায় ১,২০০ জন, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। এরপর গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন প্রায় ৪৯,০০০ জন, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক মানুষ।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান