যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতি নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এই শুল্কগুলি বাণিজ্য আলোচনার উদ্দেশ্যে নাকি বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি স্থায়ী পরিবর্তন আনতে চাইছে, তা নিয়ে হোয়াইট হাউসের দ্বিধা বিভক্ত মন্তব্যের জেরে বাড়ছে অনিশ্চয়তা।
বিশেষ করে আসন্ন এই শুল্কগুলি কবে থেকে কার্যকর হবে, তা নিয়ে ব্যবসায়ী মহল থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ।
সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজার বন্ধ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে, সাংবাদিকদের ওভাল অফিসে ডেকে পাঠান ট্রাম্প। তাঁর শুল্ক পরিকল্পনার কারণে সৃষ্ট অস্থিরতা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল সাংবাদিকদের সামনে।
ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ কি শুধু দর কষাকষির কৌশল, নাকি বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুনভাবে সাজানোর নীলনকশা? এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্পের মন্তব্য ছিল, “উভয় ধারণাই সত্যি হতে পারে। স্থায়ী শুল্কও থাকতে পারে, আবার আলোচনাও চলতে পারে।”
এই মন্তব্যের পরই যেন বাজারে ধস নামে। বিদেশি সরকার এবং ব্যবসায়ীরা যখন একটি স্পষ্ট ধারণা পেতে চাইছে, তখন হোয়াইট হাউস থেকে আসা পরস্পরবিরোধী বার্তাগুলো পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে তুলছে।
উপদেষ্টারা অবশ্য কয়েক দিন ধরে চলা শেয়ারবাজারের পতন ঠেকাতে শুল্ককে আলোচনার বিষয় হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। এর ফলে ওয়াল স্ট্রিট এবং কংগ্রেসের রিপাবলিকানদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে।
মঙ্গলবার বিকেলে এস অ্যান্ড পি ৫০০ সূচক ১.৫% বেড়েছিল।
তবে, ট্রাম্প এখনো বিদেশি পণ্য আমদানির ওপর নতুন শুল্ক বসিয়ে শত শত বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আদায়ের কথা বলছেন। এমনকি তিনি দীর্ঘদিন ধরে যে নীতি সমর্থন করে আসছেন, সেই অবস্থান থেকে সামান্যতম নড়চড় করতেও রাজি নন।
বিশ্লেষকদের মতে, এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে দেশের ভেতরে ও বাইরে ট্রাম্পের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা কমতে পারে। কারণ, তিনি সমৃদ্ধ অর্থনীতি এবং কর হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যা এখন অনেকের কাছে হতাশাজনক মনে হচ্ছে।
নর্থ ক্যারোলিনার রিপাবলিকান সিনেটর থম টিলিস হোয়াইট হাউসকে দ্রুত একটি সমাধানে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “এই পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত কি হবে, সে বিষয়ে একটি ধারণা থাকাটা খুবই জরুরি।”
অন্যদিকে, ম্যাসাচুসেটসের ডেমোক্রেট সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন অভিযোগ করেছেন, শুল্ক নিয়ে ট্রাম্পের বারবার অবস্থান পরিবর্তনের কারণে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সকালে ট্রাম্প তাঁর দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং প্রত্যেক দেশের সঙ্গে আলাদাভাবে বাণিজ্য চুক্তি করার নির্দেশ দিয়েছেন, যারা এই প্রশাসনের সঙ্গে চুক্তি করতে চাইছে।
কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা এখনো জানেন না কিভাবে এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রায় ৭০টি দেশ তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে চাইছে।
ট্রাম্পের মূল লক্ষ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশগুলোর থেকে বেশি পণ্য আমদানি করার কারণে যে বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা দূর করা।
মঙ্গলবার সকালে তিনি সামাজিক মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলার কথা জানান। তিনি লেখেন, “উভয় দেশের জন্যই একটি দারুণ চুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের শীর্ষ দল এখন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে এবং সবকিছু ইতিবাচক দেখা যাচ্ছে।”
তবে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি দূর করার কথা বলেন, তখন ট্রাম্পের মধ্যে তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। নতুন শুল্কের বিষয়ে তিনি বলেন, “হয়তো নয়।”
দীর্ঘদিন ধরেই ট্রাম্প শুল্ককে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সমাধান হিসেবে দেখেন। এমনকি অন্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে ঠকাচ্ছে বলেও তিনি মনে করেন।
গত বৃহস্পতিবার, এয়ার ফোর্স ওয়ানে করে ফ্লোরিডায় যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, “শুল্ক আমাদের দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়ায়।”
অন্যদিকে, হোয়াইট হাউসের শীর্ষ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কেভিন হ্যাসেট এবং ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট জানিয়েছেন, অনেক দেশ ট্রাম্পের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে আলোচনা করতে চাইছে।
বেসেন্ট ফক্স নিউজকে বলেন, “এপ্রিল, মে এমনকি জুন মাস পর্যন্ত সময়টা বেশ ব্যস্ত থাকতে পারে।”
কনজারভেটিভ থিংক ট্যাংক হাডসন ইনস্টিটিউটে দেওয়া বক্তৃতায় ট্রাম্পের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান স্টিফেন মিরান বলেন, শুল্কের উদ্দেশ্য নিয়ে মিশ্র বার্তা “স্বাস্থ্যকর” অভ্যন্তরীণ বিতর্কের ফল।
আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের অর্থনীতিবিদ মাইকেল স্ট্রেইন বলেন, ট্রাম্পের লক্ষ্যগুলো পরস্পরবিরোধী। তিনি বলেন, “এই শুল্কগুলো একই সঙ্গে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থা পরিবর্তন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে পরিষেবা খাত থেকে সরিয়ে উৎপাদন খাতের দিকে নিয়ে যাওয়া এবং বাণিজ্য বাধা কমানোর হাতিয়ার হতে পারে না।”
লুইজিয়ানার রিপাবলিকান সিনেটর জন কেনেডি এই অস্পষ্টতার জন্য ট্রাম্পের উপদেষ্টাদের দায়ী করেছেন।
অন্যদিকে, লুইজিয়ানার হাউজ স্পিকার মাইক জনসন বলেছেন, আমেরিকানরা বোঝে ট্রাম্প বাণিজ্য অসামঞ্জস্যতা দূর করতে চাইছেন এবং তিনি প্রেসিডেন্টের ওপর আস্থা রাখেন।
এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব কেমন হবে, তা নিয়ে এখনো কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিশ্ব অর্থনীতির এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রপ্তানি ও আমদানি খাতে পরিবর্তন আসতে পারে।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস