সিরিয়ার আকাশে যুদ্ধের দামামা হয়তো এখন স্তিমিত, কিন্তু মাটির নিচে এখনো লুকিয়ে আছে মৃত্যুর ফাঁদ। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে ইদlib প্রদেশে, যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ হিসেবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মাইন।
যা প্রতিনিয়ত কেড়ে নিচ্ছে মানুষের জীবন, কেড়ে নিচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার। সম্প্রতি, এসব মাইন বিস্ফোরণে আহত ও নিহত হওয়ার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও মাইনগুলো কিভাবে এখনো বিপদ ডেকে আনছে, সেই ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দা সুলাইমান খলিলের (২১) কথাই ধরুন।
তিনি জলপাই ক্ষেতে কাজ করার সময় মাইন বিস্ফোরণে দুটি পা হারান। “আমি ভেবেছিলাম, মরে গেছি,”– ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন।
“প্রথম বিস্ফোরণে আমার বাঁ পা মারাত্মকভাবে জখম হয়। এরপর দ্বিতীয় মাইনটি আমার ডান পা হাঁটু থেকে উড়িয়ে দেয়।”
শুধু সুলাইমান নন, যুদ্ধের বিভীষিকা এখনো তাড়া করে ফিরছে জালাল আল-মারুফের মতো আরও অনেককে। তিনি ছাগল চড়াতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণে একটি পা হারিয়েছেন।
উন্নত চিকিৎসার অভাবে এখনো তিনি স্বাভাবিক জীবন থেকে অনেক দূরে।
আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ‘ইনসো’র তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে এ পর্যন্ত মাইন ও বিস্ফোরক দ্রব্য-সংক্রান্ত ঘটনায় অন্তত ২৪৯ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৬০ জন শিশু।
আহত হয়েছেন আরও ৩৭৯ জন। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) সতর্ক করে বলেছে, অবিলম্বে মাইন অপসারণের কাজ শুরু করা না হলে, আরও অনেক বেসামরিক নাগরিক হতাহত হবেন।
ইতোমধ্যে, মাইন অপসারণের কাজ শুরু হয়েছে। তবে, এই কাজটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং সময়সাপেক্ষ।
সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাইন অপসারণ ইউনিটের সদস্য আহমেদ জুম্মা জানান, “এগুলো সরাতে অনেক সময় লাগবে।” তিনি আরও জানান, তাঁদের দলের ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য মাইন অপসারণ করতে গিয়ে অঙ্গ হারিয়েছেন, আর নিহত হয়েছেন এক ডজনের বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিরিয়ার প্রাক্তন ফ্রন্টলাইন অঞ্চলগুলোতে এখনো কয়েক হাজার মাইন পুঁতে রাখা আছে।
এসব মাইন মূলত সিরীয় সরকারি বাহিনী, তাদের মিত্র এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো ব্যবহার করেছে। এমনকি, বাশার আল-আসাদের সরকারের পতনের পরও মাইনগুলো অপসারণের তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের জন্য উন্নত চিকিৎসা ও সহায়তার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, মাইন শুধু জীবন কেড়ে নেয় না, বরং দীর্ঘমেয়াদি মানসিক আঘাত, বাস্তুচ্যুতি, সম্পদ হারানো এবং মৌলিক পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার মতো সমস্যাও তৈরি করে।
এইচআরডব্লিউ’র পক্ষ থেকে একটি বেসামরিক মাইন অ্যাকশন কর্তৃপক্ষ গঠনের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে, যারা জাতিসংঘ মাইন অ্যাকশন সার্ভিসের (ইউএনএমএএস) সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার মানুষের জীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে, মাইনমুক্ত একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা অপরিহার্য।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দ্রুত এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে আর কোনো সুলাইমান বা জালাল-কে পঙ্গুত্ব বরণ করতে না হয়, আর কোনো শিশুকে অকালে জীবন দিতে না হয়।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস