ওজন কমানোর পুরনো ধারণা কি তবে হারাতে বসেছে? বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় ‘ওয়েটওয়াচার্স’-এর (WeightWatchers) ভবিষ্যৎ এখন কি সঙ্কটে? সম্প্রতি বাজারে আসা নতুন কিছু ওষুধের কারণে এই সংস্থাটি বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
খবর বলছে, শীঘ্রই দেউলিয়া হওয়ার জন্য আবেদন করতে পারে ওয়েটওয়াচার্স।
১৯৬৩ সালে নিউইয়র্কে স্থূলকায় ব্যক্তিদের জন্য একটি সহায়তা গোষ্ঠী হিসেবে যাত্রা শুরু করে ওয়েটওয়াচার্স। তারপর এটি কয়েক দশক ধরে ওজন কমানোর স্বপ্ন দেখিয়ে বিশ্বব্যাপী একটি বিশাল ব্যবসায় পরিণত হয়েছিল।
এই সংস্থার ‘পয়েন্ট-ভিত্তিক’ খাদ্য তালিকা অনুসরণ করে লক্ষ লক্ষ মানুষ ওজন কমিয়েছেন। তাদের জন্য ছিল রান্নার বই, খাদ্যদ্রব্য, সাপ্তাহিক ওজন পরীক্ষা এবং ‘নিরপেক্ষ’ মিটিংয়ের ব্যবস্থা।
সেইসঙ্গে ছিল একটি খাদ্য ট্র্যাকিং অ্যাপও। কিন্তু শোনা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে ‘ডব্লিউ ডব্লিউ’ (WW) নামে পরিচিত হওয়া ওয়েটওয়াচার্সের সদস্যরা হয়তো খুব শীঘ্রই তাদের ওজন মাপার যন্ত্র সরিয়ে রাখতে পারেন।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের খবর অনুযায়ী, ঋণদাতাদের সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হলে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ডব্লিউ ডব্লিউ ইন্টারন্যাশনাল দেউলিয়া হওয়ার জন্য আবেদন করতে প্রস্তুত হচ্ছে এবং এর নিয়ন্ত্রণ ঋণদাতাদের হাতে চলে যেতে পারে।
জানা গেছে, সংস্থাটি ১.৪ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ১৫,০০০ কোটি টাকা) এর বেশি ঋণে জর্জরিত।
ওষুধ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানী এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওজন কমানোর ইনজেকশন ‘ওজেম্পিক’-এর (Ozempic) মতো ওষুধের আবির্ভাবের পর থেকে এই ধরনের ব্যবসার বড় পরিবর্তন হয়েছে। সম্ভবত, এই কারণেই ওয়েটওয়াচার্স-এর আর্থিক সঙ্কট।
কিং’স কলেজ লন্ডনের জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘জো’ (Zoe) নামক বিজ্ঞান ও পুষ্টি কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা টিম স্পেক্টর মনে করেন, ওয়েটওয়াচার্স-এর এই অবস্থা হওয়াটা স্বাভাবিক।
তার মতে, একসময় যারা স্থূলতা নিয়ে হতাশায় ভুগতেন, তাদের জন্য ওয়েটওয়াচার্স-এর মিটিংগুলো ছিল আশ্রয়স্থল। তিনি আরও যোগ করেন, ক্যালোরি গণনা করে ওজন কমানোর ধারণা বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে কার্যকরী হয় না, কারণ ক্যালোরি কমালে ক্ষুধা বাড়ে।
ওয়েটওয়াচার্স কম ক্যালোরির কিন্তু পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিত। তবে অধ্যাপক স্পেকটরের পরামর্শ হলো, এমন খাবার খাওয়া উচিত যা শরীরের জন্য উপকারী এবং প্রচুর পরিমাণে ফাইবারযুক্ত।
তাঁর মতে, কম ক্যালোরিযুক্ত, কম ফ্যাটযুক্ত বা কম চিনিযুক্ত খাবারের পরিবর্তে ভালো মানের খাবার খাওয়া উচিত।
তবে, ওয়েটওয়াচার্সের প্রধান সমস্যা হলো, তারা ‘কম খান, বেশি ব্যায়াম করুন’—এই ধারণাকে গুরুত্ব দেয়।
কিন্তু ‘ওজেম্পিক’, ‘ওয়েগোভি’ (Wegovy) এবং ‘মাউঞ্জারো’র (Mounjaro) মতো ওজন কমানোর ওষুধগুলোর সাফল্যের কারণে এখন ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব অনেক বেশি।
মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি ‘ইলি লিলি’ (Eli Lilly), যারা ‘মাউঞ্জারো’ তৈরি করে, ঘোষণা করেছে যে তারা আগামী বছর যুক্তরাজ্যে একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি দৈনিক ওজন কমানোর পিল বাজারে আনতে পারে।
অন্যদিকে, নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রয় টেলর ১৪ বছর আগে একটি যুগান্তকারী খাদ্যতালিকা তৈরি করেছিলেন, যা দেখিয়েছিল যে দ্রুত ওজন কমানোর মাধ্যমে টাইপ ২ ডায়াবেটিসও নিরাময় করা যেতে পারে।
তার মতে, ওয়েটওয়াচার্সের ধীরে ধীরে ওজন কমানোর ধারণা অনেকের জন্য কার্যকর ছিল না।
ওয়েটওয়াচার্সের প্রাক্তন প্রশিক্ষক রুথ জানিয়েছেন, মিটিংগুলো তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যেখানে সদস্যরা একে অপরের সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারতেন।
কিন্তু অতিমারীর সময় কর্মী ছাঁটাইয়ের কারণে মিটিংয়ের সংখ্যা কমে যায়। পরবর্তীতে ওজন কমানোর ওষুধ চালু হওয়ার পর, সদস্যদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা যায়।
তবে, ওয়েটওয়াচার্সের প্রতিদ্বন্দ্বী ‘স্লিমমিং ওয়ার্ল্ড’-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ওজন কমানোর ওষুধ স্থূলতার একমাত্র সমাধান নয়।
তাদের মতে, খাদ্য, শারীরিক কার্যকলাপ এবং মানসিকতার পরিবর্তনের জন্য সকলের সমর্থন প্রয়োজন।
ওজন কমানোর এই নতুন দৌড়ে ওয়েটওয়াচার্স-এর ভবিষ্যৎ কী হবে, তা সময়ই বলবে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান