রমজান মাসের প্রথম শুক্রবার, জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদে প্রায় ৯০ হাজার ফিলিস্তিনি নামাজ আদায় করেছেন। ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তার মধ্যে এই নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। খবরটি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস।
ফিলিস্তিনিদের জন্য এবারের রমজান মাসের নামাজ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ গত এক বছরে এই প্রথম তারা জেরুজালেমে প্রবেশ করতে পেরেছেন। ইসরায়েল অধিকৃত অঞ্চল থেকে আসা ৫৫ বছরের বেশি বয়সী পুরুষ এবং ৫০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের নামাজে অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়। তবে, সম্প্রতি পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে উত্তেজনা বেড়েছে। শুক্রবারের নামাজে সরাসরি কোনো সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়নি।
গত বছর রমজান মাসে গাজায় যুদ্ধ চলছিল। এবার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন, কারণ এখানে একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি চলছে, যা এখনো অনিশ্চিত। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে, ইসরায়েল গাজায় খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। হামাসের কাছে একটি সংশোধিত চুক্তি মেনে নেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছে।
গাজায় ধ্বংসস্তূপের মাঝেও রমজানের প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গাজা শহরের ইমাম শাফি’ই মসজিদের ধ্বংসাবশেষে হাজার হাজার মানুষ শুক্রবারের জামাতে অংশ নেয়। রমজান মাসে মুসলমানরা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপবাস পালন করেন, যা আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ, দরিদ্র ও ক্ষুধার্তদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়, গাজাবাসীরা তাদের তাঁবুর চারপাশে ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের ধ্বংসাবশেষে রামজানের আলোকসজ্জা করে এবং ইফতারের জন্য দীর্ঘ টেবিল তৈরি করে, যেখানে বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা খাবার পরিবেশন করে।
আল-আকসা মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসা নাফেজ আবু সাকের জানান, তিনি উত্তর পশ্চিম তীরের আকরাবা গ্রাম থেকে সকাল ৭টায় রওনা হয়ে ইসরায়েলি চেকপোস্ট পার হয়ে জেরুজালেমে পৌঁছতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় নিয়েছেন। তিনি বলেন, “যদি পশ্চিম তীরের সব মানুষকে এখানে আসার অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে সব শহর, গ্রাম ও শরণার্থী শিবির থেকে মানুষ আল-আকসায় নামাজ পড়তে আসবে।
আরেকজন মুসল্লি এজাত আবু লাকিয়া বলেন, “এখানে নামাজ পড়ার প্রতিদান অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে ৫০০ গুণ বেশি। পথ কঠিন হলেও, আল্লাহর কাছ থেকে এর অনেক বড় পুরস্কার রয়েছে।
মসজিদ চত্বরে অবস্থিত সোনালী গম্বুজের পাদদেশে মুসল্লিরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে খুতবা শোনেন এবং নামাজ আদায় করেন। আল-আকসা মসজিদ পরিচালনা কমিটির হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৯০ হাজার মানুষ এই নামাজে অংশ নেয়। ইসরায়েলি পুলিশ জানিয়েছে, তারা ওই এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করতে অতিরিক্ত কয়েক হাজার সদস্য মোতায়েন করেছে।
জেরুজালেমের পুরাতন শহর এবং আল-আকসা মসজিদ চত্বর, যা ইহুদিদের কাছে টেম্পল মাউন্ট হিসেবে পরিচিত, অতীতে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের স্থান হিসেবে পরিচিত ছিল। পুরাতন শহর পূর্ব জেরুজালেমের অংশ, যা ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল দখল করে। ইসরায়েল পরে এই এলাকা নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করে নেয়, যদিও ফিলিস্তিনিরা এটিকে তাদের ভবিষ্যৎ স্বাধীন রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে দাবি করে।
নামাজে অংশগ্রহণের জন্য পশ্চিম তীর থেকে আসা হাজার হাজার ফিলিস্তিনি জেরুজালেমের ক্বালান্দিয়া চেকপোস্টে ভিড় করেন। তবে, অনেকের কাছে প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র না থাকায় অথবা চেকপোস্ট বন্ধ করে দেওয়ায় তাদের ফিরে যেতে হয়। ইসরায়েলি পুলিশ জানায়, তারা পশ্চিম তীর থেকে ১০ হাজার ফিলিস্তিনিকে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে, তবে কতজন প্রবেশ করতে পেরেছে, সে বিষয়ে তারা কিছু জানায়নি।
মোহাম্মদ ওওয়াইসাত জানান, চেকপোস্ট বন্ধ করে দেওয়ায় তিনি ফিরে যেতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, “এখানে সবাই, যুবক, বৃদ্ধ এবং নারীরা অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু তাদের কাউকেই চেকপোস্ট পার হতে দেওয়া হয়নি।
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ে হামাসের হাতে বন্দী ২৫ জন ইসরায়েলিকে মুক্তি দেওয়া হয়, যাদের মধ্যে আটজনের মরদেহও ছিল। এর বিনিময়ে ইসরায়েল প্রায় ২ হাজার ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেয়।
তবে, যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, যেখানে অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি এবং গাজা থেকে ইসরায়েলি সৈন্য প্রত্যাহার করার কথা ছিল। ইসরায়েল এই বিষয়ে আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি হচ্ছে না। তারা হামাসের কাছে তাদের জিম্মিদের অর্ধেককে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ানোর এবং একটি স্থায়ী চুক্তিতে পৌঁছানোর প্রস্তাব দিয়েছে।
ইসরায়েল বলেছে, হামাস তাদের প্রস্তাব গ্রহণ না করা পর্যন্ত গাজায় সাহায্য সরবরাহ বন্ধ রাখা হবে এবং প্রয়োজনে তা আরও বাড়ানো হতে পারে। মানবাধিকার সংস্থা এবং আরব দেশগুলো ইসরায়েলের এই পদক্ষেপকে ‘ক্ষুধার কৌশল’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। হামাস তাদের মূল যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছে।
মিশরের রাষ্ট্রীয় তথ্য পরিষেবা জানিয়েছে, শুক্রবার হামাসের একটি প্রতিনিধি দল চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা করতে এবং দ্বিতীয় ধাপের বিষয়ে চাপ দিতে কায়রোতে পৌঁছেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে গাজায় প্রায় ৪৮ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। হামাসের গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে চালানো হামলায় প্রায় ১,২০০ জন নিহত হয় এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। যাদের মধ্যে অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক ছিলেন। যুদ্ধবিরতি চুক্তি অথবা অন্যান্য ব্যবস্থার মাধ্যমে অনেককে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, হামাসের কাছে এখনো ২৪ জন জীবিত জিম্মি এবং আরও ৩৪ জনের মরদেহ রয়েছে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস