মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি কর্মীদের চাকরিচ্যুতি: খরচ কমানোর জেরে পরিবারে বিভেদ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কর্মীদের চাকরিচ্যুতির ঘটনা দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজনকে আরও তীব্র করে তুলেছে। সম্প্রতি, খরচ কমানোর উদ্দেশ্যে ফেডারেল সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর ফলে, একদিকে যেমন কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষেরা নতুন চাকরির সন্ধান করছেন, তেমনই স্বাস্থ্য বীমার মতো মৌলিক সুবিধাগুলো থেকেও তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যদিকে, এমন কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁদের আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে সহানুভূতি তো দূরের কথা, উল্টো বিদ্রূপ শুনতে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বিদ্যমান তীব্র বিভাজন চাকরি হারানো কর্মীদের পরিবার ও বন্ধুদের মধ্যে ফাটল ধরাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এই বিভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। চাকরি হারানো কর্মীরা যখন তাঁদের কষ্টের কথা জানাচ্ছেন, তখন তাঁদের পরিবারের কেউ কেউ সরকারের এই পদক্ষেপকে সমর্থন করছেন। তাঁদের মতে, সরকারের আকার কমানোর জন্য এমনটা করা জরুরি।
এই পরিস্থিতির শিকার হওয়া এক ব্যক্তির নাম লুক টোবিন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইডাহোর নেজ পার্স ন্যাশনাল ফরেস্টে বন বিভাগের টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করতেন। গত মাসে চাকরি হারানোর পর তিনি দ্রুত স্বাস্থ্য বীমার সুবিধা টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপত্র সংগ্রহ করেছেন এবং নতুন চাকরির জন্য আবেদন করছেন। ফাস্ট ফুডের দোকানে কাজ করতেও তাঁর আপত্তি নেই। তবে পরিবারের কিছু সদস্যের প্রতিক্রিয়া তাঁর কাছে সবচেয়ে কষ্টের। তাঁরা মনে করেন, সরকারের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ ফিরিয়ে আনতে এমনটা হওয়া দরকার। টোবিন বলেন, “তাঁরা তাঁদের আদর্শ আর রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারছেন না। এমনকি আপনজনদের সমর্থন করার ক্ষেত্রেও তাঁরা একই মানসিকতা দেখাচ্ছেন।”
ক্রিস্টিন জেন নামের আরেকজন নারীও একই অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন। ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিসে তাঁর চাকরির নিয়োগ স্থগিত করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, সম্ভবত সেই চাকরিটি বাতিল হয়ে যাবে। তিনি যখন তাঁর স্বপ্নের চাকরি হারানোর হতাশায় ভুগছেন, তখন তাঁর রক্ষণশীল পরিবারের সদস্যরা তাঁর সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। এমনকি অনেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছেন। জেন বলেন, “আমার জীবনটা যেন ভেঙে যাচ্ছে, কারণ আমি আমার পছন্দের পেশায় কাজ করতে পারছি না। তার ওপর পরিবারের সমর্থন না পাওয়াটা অনেক বেশি কষ্টের।”
এই বিভেদ জেনের মায়ের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। তিনি নিজেও আগে ফেডারেল কর্মচারী ছিলেন। কিন্তু মেয়ের সমালোচনার জবাবে তিনি প্রেসিডেন্টের প্রতি সমর্থন জানান। জেন বলেন, “তিনি সম্ভবত বিশ্বাস করেন যে সরকারি কর্মচারীরা পরজীবী এবং অকর্মণ্য, যদিও তিনি নিজেও একসময় সরকারি চাকরি করেছেন।”
মার্কিন সরকারের ‘ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি’ (DOGE) নামে পরিচিত একটি সংস্থা সরকারি ব্যয় সংকোচনের অংশ হিসেবে কর্মী ছাঁটাইয়ের এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে। যদিও ঠিক কতজন কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে, তার কোনো সরকারি হিসাব নেই, তবে ধারণা করা হচ্ছে এই সংখ্যা কয়েক হাজার এবং দেশটির প্রায় সব প্রান্তেই এর প্রভাব পড়েছে।
শিকাগোর বাসিন্দা এরিক অ্যান্ডারসন ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিসের জীববিজ্ঞানী ছিলেন। চাকরি হারানোর ধাক্কা সামলে উঠার আগেই তিনি তাঁর এক ফুফুর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টে দেখেন, যেখানে DOGE-এর এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানানো হয়েছে। অ্যান্ডারসন বলেন, “আমার ফুফু লিখেছেন, এই ধরনের অপচয় বন্ধ হওয়াটা দারুণ ব্যাপার।” এই বিষয়টি তাঁকে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করে। তিনি বলেন, “আপনাদের কি মনে হয় আমি একজন অপচয়?”
এই পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এড়িয়ে চলছেন কলোরাডোর বন বিভাগের টেকনিশিয়ান এরিকা স্টাবস। চাকরি হারানোর পর তাঁর পরিচিতদের মধ্যে অনেকেই তাঁকে সমর্থন জানালেও, কেউ কেউ তাঁর মতো কর্মীদের চাকরিকে অপ্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেছেন। স্টাবস বলেন, “তাঁরা বলেন, এটা শুধু অপচয় কমানোর অংশ, তোমার কাজটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি বলছি না যে এটা পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, তবে এটা আমার কাজ এবং আমার কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ।”
ফেডারেল কর্মীদের ছাঁটাই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উল্লাস প্রকাশ করা হচ্ছে এবং DOGE-কে আরও বেশি কর্মী ছাঁটাই করার আহ্বান জানানো হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে, একজন মানুষের দুঃখ যেন অন্যজনের আনন্দের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে, এই পরিস্থিতিতে কেউ কেউ সহানুভূতির হাতও বাড়িয়ে দিয়েছেন। নেভাদার লেক মিড ন্যাশনাল রিক্রিয়েশন এলাকার একজন জলজ বাস্তুবিদ রিলে র্যাকলিফকে চাকরিচ্যুত করার পর অনেক বন্ধু ও আত্মীয় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং চাকরির জন্য সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছেন। র্যাকলিফ জানান, কয়েকজন বন্ধু তাঁকে সান্ত্বনা জানালেও, তাঁরা সরকারের এই পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন। র্যাকলিফ বলেন, “আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগে যখন তাঁরা বলেন, আমার মতো মানুষেরা নাকি অলস এবং অকর্মণ্য ছিল, যারা কোনো কাজ না করে বড় অঙ্কের বেতন পেত।” তিনি আরও বলেন, “আমি চাই প্রেসিডেন্ট আসুক এবং ১২০ ডিগ্রি গরমের মধ্যে কাঁটাযুক্ত শ্যাওলার মধ্যে পরজীবী শামুক খুঁজে দেখুক। তিনিই তো সরকারি টাকায় গল্ফ খেলেন। আমি তো গল্ফ খেলতেও জানি না।”
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস