আন্তর্জাতিক নারী দিবস: কিছু নারীর জন্য, সবার জন্য নয়?
প্রতি বছর ৮ই মার্চ তারিখে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা নারী অধিকারের কথা বলে থাকে। এই দিনে নারীদের ক্ষমতায়নের কথা শোনা যায়, বিভিন্ন প্রচারণায় ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ সমাজ গড়ার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই দিবসটি কি সত্যিই সব নারীর কথা বলে? নাকি কিছু বিশেষ নারীর সাফল্যের গল্প প্রচারের সুযোগ তৈরি করে?
সম্প্রতি আল জাজিরায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এই দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। নিবন্ধে বলা হয়েছে, নারী দিবসের আলোচনা কর্পোরেট জগতের সুবিধা অনুযায়ী সাজানো হয়। যুদ্ধের শিকার, নিপীড়িত এবং সহিংসতার শিকার হওয়া নারীদের কথা এতে সেভাবে আসে না। বরং, পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি ও মিডিয়ার পছন্দের বিষয়গুলোই প্রাধান্য পায়।
নিবন্ধটিতে উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, যখন ইরানের নারীরা হিজাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল, তখন পশ্চিমা বিশ্বে তাদের প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছিল। ইউক্রেনের নারীরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, তাদের সাহসিকতাকে প্রশংসিত করা হয়েছিল। কিন্তু যখন ফিলিস্তিনের নারীরা তাদের ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপ থেকে সন্তানদের মৃতদেহ খুঁজে বের করেন, তখন পশ্চিমা বিশ্ব নীরব থাকে, অথবা তাদের প্রতি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়।
আফগানিস্তানের নারীদের সমর্থনে অনেকে সোচ্চার হলেও, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ফিলিস্তিনি নারীদের ওপর হওয়া নির্যাতনের বিষয়ে তেমন কোনো কথা শোনা যায় না। নিবন্ধে আফগান নারীদের প্রতি সমর্থন জানানোর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হলেও, একই সঙ্গে ফিলিস্তিনি নারীদের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের নীরবতাকে তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। লেখক মনে করেন, যারা ফিলিস্তিনের নারীদের দুর্দশার প্রতি চোখ বন্ধ করে থাকে, তারা নারী অধিকারের কথা বলার নৈতিক অধিকার রাখে না।
আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থান পশ্চিমা দেশগুলোর হস্তক্ষেপের ফল ছিল। সেই হস্তক্ষেপের ফলে সেখানকার নারীরা আরও বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। বর্তমানে যখন আফগান নারীদের অধিকারের কথা বলা হচ্ছে, তখন ফিলিস্তিনের নারীদের কথা সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।
গাজায় হাসপাতালগুলোতে বোমা হামলার শিকার হয়ে যখন অন্তঃসত্ত্বা নারীরা রাস্তায় সন্তান জন্ম দিতে বাধ্য হয়েছেন, ইসরায়েলি স্নাইপারদের গুলিতে যখন নারী সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ নিহত হয়েছেন, অথবা মার্কিন বোমা হামলায় ফিলিস্তিনি শিশুরা নিহত হয়েছে, তখন পশ্চিমা বিশ্ব নীরব ছিল। এই দ্বিচারিতা আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মূল চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
নিবন্ধে আরও বলা হয়েছে, সাম্রাজ্যবাদ, যুদ্ধ ও দখলদারিত্বকে জায়েজ করার হাতিয়ার হিসেবে অনেক সময় নারীবাদের ব্যবহার করা হয়। আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ফরাসি সরকার নারীদের ‘মুক্ত’ করার নামে হিজাব পরার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছিল। কিন্তু একই সময়ে তারা আলজেরীয় নারীদের ওপর নির্যাতনও চালিয়েছিল।
ফিলিস্তিনি নারীদের পশ্চিমা বিশ্ব সবসময় ভিকটিম হিসেবে দেখায়। তাদের দুর্দশার জন্য ফিলিস্তিনি পুরুষদের দায়ী করা হয়। ইসরায়েলি কর্মকর্তা ও তাদের পশ্চিমা মিত্ররা ফিলিস্তিনি নারীদের নিজেদের সংস্কৃতি ও সমাজের হাত থেকে ‘রক্ষা’ করার কথা বলেন। কিন্তু তাদের ওপর ইসরায়েলি দখলদারিত্বের কারণে হওয়া নির্যাতনকে তারা উপেক্ষা করেন।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস এখন একটি আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। যেখানে কিছু নারী অধিকার সংগঠন ও রাজনীতিবিদ তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ অনুযায়ী নারীদের বেছে নেন এবং পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষার জন্য অন্যদের ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকেন।
গাজায় নারীদের ওপর হওয়া গণহত্যা এবং উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার পরিবর্তে, পশ্চিমা বিশ্ব নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।
আসুন, আমরা সবাই ফিলিস্তিনি নারীদের পাশে দাঁড়াই, তাদের কণ্ঠস্বরকে আরও জোরালো করি। তাদের সংগ্রামকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরি। তাদের ওপর হওয়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা