গাজা শহরের ধ্বংসস্তূপের মাঝে, এক টুকরো শান্তির আশ্রয়: নূরের তাঁবু-সেলুন
গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলার বিভীষিকা আজও মানুষকে তাড়া করে ফেরে। ঘরবাড়ি হারিয়ে, উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলোর জীবনে টিকে থাকার লড়াই যখন প্রধান, তখনো যেন সৌন্দর্যচর্চার আকাঙ্ক্ষাটুকু হারায়নি তারা। তেমনই এক জন তরুণী, নূর আল-গামারি। যিনি যুদ্ধের ভয়াবহতার মাঝেও নারীদের জন্য খুলেছেন একটি বিউটি সেলুন।
নূরের সেলুন আসলে একটি নীল রঙের তাঁবু, যা গাজা শহরের আল-শুজাইয়ার ধ্বংসস্তূপের পাশে স্থাপন করা হয়েছে। তাঁবুর ভেতরে একটি ভাঙা আয়না, কিছু প্রসাধন সামগ্রী এবং সৌন্দর্যচর্চার সরঞ্জাম নিয়েই নূরের জগৎ। বাইরে সাদা কাগজে হাতে লেখা একটি সাইনবোর্ড, যাতে লেখা রয়েছে ‘নূরের সেলুন’।
নূর পেশায় একজন রূপচর্চাকারী। নার্সিং কলেজের পড়া ছেড়ে, রূপচর্চার প্রতি ভালোবাসার টানে তিনি এই পেশায় আসেন। উদ্বাস্তু হওয়ার আগে তার একটি স্থায়ী সেলুন ছিল, কিন্তু যুদ্ধের কারণে সবকিছু হারিয়ে যায়। যখন তিনি ও তার পরিবার উত্তরে ফিরে আসেন, তখন ধ্বংসস্তূপের মাঝে এই তাঁবু-সেলুন তৈরি করেন তিনি।
আমানি দুয়েইমা নামের এক নারী তার ১৬ বছর বয়সী মেয়ে আয়াসহ নূরের কাছে আসেন। তাদের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল – সন্ধ্যায় তাদের এক আত্মীয়ের বিয়ে। আমানি চান ভ্রু প্লাক করতে, আর আয়নার পুরো মুখে মেকআপ করতে চায়। যুদ্ধের এই কঠিন সময়েও, নূরের সেলুন যেন নারীদের জন্য এক টুকরো আনন্দের আশ্রয়।
নূরের কাছে আসা নারীদের গল্পগুলোও বেদনার। উদ্বাস্তু শিবিরে থাকা নারীদের ত্বকে রোদ লেগে পোড়া দাগ, কাঠ-কয়লার আগুনে রান্না করতে গিয়ে তাদের কষ্টের কথা শোনেন তিনি। তাদের চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। নূরের মতে, এই পরিস্থিতিতে নারীদের আত্ম-যত্ন নেওয়াটা খুব জরুরি।
আমানি জানান, যুদ্ধের শুরুতে রূপচর্চার কথা তিনি চিন্তাও করেননি। কিন্তু পরে, দেইর আল-বালাহ-এ অনুরূপ একটি সেলুনে যাওয়ার পর তিনি নিয়মিত সেখানে যেতে শুরু করেন। আয়নার সামনে নিজেকে পরিপাটি দেখতে ভালো লাগে তার। “চারপাশের এত দুঃখের মাঝে, সেলুনে যাওয়াটা যেন এক ধরনের মুক্তি,” যোগ করেন তিনি।
নূর মনে করেন, গাজার নারীদের প্রতি যুদ্ধটা একটু বেশিই নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। তাদের ঘর কেড়ে নিয়েছে, নিরাপত্তা ছিনিয়ে নিয়েছে, এমনকি নিজেদের প্রতি যত্ন নেওয়ার সুযোগ থেকেও তারা বঞ্চিত হয়েছে।
নূরের কাছে আসা এক নারীর গল্প এখনো তার মনে আছে। ওই নারীর মা-বাবা এবং ভাইবোনদের ইসরায়েলি হামলায় মৃত্যু হয়। শোকের কারণে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। নূর তাকে থ্রেডিং, ভ্রু প্লাক, চুল কাটা এবং বিনামূল্যে ফেস ম্যাসেজ ও মাস্কের ব্যবস্থা করেন। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে সেই নারীর চোখে আনন্দের অশ্রু এসেছিল।
যুদ্ধ শুরুর আগে, নূরের একটি স্থায়ী সেলুন তৈরি করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বোমা হামলায় তার জীবন এলোমেলো হয়ে যায়। উদ্বাস্তু হওয়ার পর, তিনি যখন দেখেন নারীরা তাদের সৌন্দর্যচর্চা নিয়ে কথা বলছেন, তখন তিনি তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।
নূর দিনে পাঁচ থেকে আটজন গ্রাহকের সেবা করেন। তিনি এখানকার বাস্তবতা বোঝেন, তাই তার সেবার মূল্য খুবই কম রাখেন।
আমানি যখন জানতে পারলেন নূরের কাছে চুল রং করার ব্যবস্থা নেই, তখন তিনি একটু হতাশ হলেন। কারণ, সেখানে পানি ও বিদ্যুতের অভাব।
নূর বলেন, “আমি সাধারণ সরঞ্জাম দিয়ে কাজ করি এবং শুধুমাত্র মৌলিক পরিষেবাগুলো দিতে পারি।”
নূর যখন আয়াকে সাজাচ্ছিলেন, তখন আমানি মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তিনি চান তার মেয়ে সবসময় নিজের যত্ন নিক। “আমি চাই সে বড় হয়ে বুঝুক, যাই ঘটুক না কেন, নিজের যত্ন নেওয়াটা জরুরি। আমি তাকে একটু আনন্দ দিতে চাই। এই যুদ্ধে আমরা যা দেখেছি, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।”
নূর চান, যুদ্ধ শেষ হলে তিনি তার ব্যবসা বাড়াবেন এবং আরও বেশি পরিষেবা নিয়ে আসবেন। তার বার্তা হলো, “সবাই নিজের যত্ন নিন, জীবন খুব ছোট।”
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা