ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণে উদ্বাস্তু হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। সম্প্রতি, ইসরায়েলি সেনারা ফিলিস্তিনের শরণার্থী শিবিরগুলোতে অভিযান চালানোয় সেখানকার বাসিন্দারা ঘরবাড়ি হারাতে বাধ্য হচ্ছেন। আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
ফেব্রুয়ারির শুরুতে, ইসরায়েলি বাহিনী নূর শামস শরণার্থী শিবিরে প্রবেশ করে ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেয়, দোকানপাট গুঁড়িয়ে দেয় এবং রাস্তাঘাট ধ্বংস করে দেয়। এই শিবিরটি তুলকারেম শহরের কাছে অবস্থিত, যেখানে গত কয়েক বছরে ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান বেড়েছে, বিশেষ করে তুলকারেম শরণার্থী শিবিরে। ইসরায়েলের এই ধ্বংসযজ্ঞের কারণে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং তাদের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
হামদান ফাহমাউয়ি নামের এক ব্যক্তির দোকানও এই হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি জানান, এক বছরের মধ্যে তার দোকান তিনবার ভাঙা হলো। ২৬শে ফেব্রুয়ারি, ৪৬ বছর বয়সী ফাহমাউয়ি তার ১৭ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে কিছু কর্মচারীসহ দোকানে যান, যদিও এর আগে তিনি এলাকা ছেড়ে গিয়েছিলেন। তিনি দোকানে গিয়ে কিছু টাকা ও জরুরি কাগজপত্র নিতে চেয়েছিলেন। ফাহমাউয়ি বলেন, “ইসরায়েলি সেনারা আমাদের দোকান থেকে বের হয়ে যেতে বলে। তাদের একজন আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে, আমরা নিজেদেরকে তখন বিপদের মধ্যে অনুভব করি, তবে সৌভাগ্যবশত কেউ আহত হয়নি।”
গত ২১শে জানুয়ারি থেকে, গাজায় যুদ্ধ বিরতির কয়েক দিন পর থেকেই ইসরায়েলি বাহিনী পশ্চিম তীরে অভিযান শুরু করে। এর ফলস্বরূপ, অন্তত ৪০ হাজার ফিলিস্তিনিকে তাদের ঘর থেকে জোর করে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনীর নতুন অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন আয়রন ওয়াল’। তাদের দাবি, এই অভিযানের মূল লক্ষ্য হলো হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) এর সঙ্গে জড়িত ‘ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোকে’ নির্মূল করা।
আন্তর্জাতিক সংকট গ্রুপের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে ফিলিস্তিনের তরুণরা ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী তৈরি করে। তবে, তারা ইসরায়েলি সেনা বা অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের জন্য তেমন কোনো হুমকি তৈরি করতে পারেনি। বরং, শরণার্থী শিবিরগুলোতে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের সময় তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।
বিশ্লেষক, স্থানীয় বাসিন্দা ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ইসরায়েল সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সক্ষমতা বাড়িয়ে দেখিয়ে তাদের ধ্বংসযজ্ঞকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের বৃহত্তর পরিকল্পনা হলো, পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা।
আল-হাক-এর মানবাধিকার গবেষক মুরাদ জাদাল্লাহ বলেন, “বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষগুলো দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তারা জানে না তাদের কী করা উচিত বা তারা কী করবে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা এক নতুন অনিশ্চয়তার মধ্যে পৌঁছে গেছি।”
১৭ বছর বয়সী নূরদিন আলী জানান, অনেক পরিবার নূর শামস থেকে পালিয়ে গিয়ে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু ইসরায়েলি বাহিনী আশেপাশের বাড়িগুলোতেও অভিযান চালালে তাদের দ্বিতীয়বার বাস্তুচ্যুত হতে হয়।
নূরদিন আলী জানান, ইসরায়েলি বাহিনী সাধারণত শরণার্থী শিবিরের ভেতরের ও আশেপাশের বাড়িগুলোকে অস্থায়ী ‘জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্র’-এ পরিণত করে। তিনি বলেন, “ইসরায়েলিরা একটি এলাকার একটি বাড়িতে প্রবেশ করে এবং সেটি দখল করে নেয়। এরপর ওই এলাকার কেউ গুলিবিদ্ধ হওয়া বা গ্রেফতার হওয়ার ঝুঁকি ছাড়া তাদের বাড়ি থেকে বের হতে বা সেখানে প্রবেশ করতে পারে না।”
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার কারণে হাজার হাজার মানুষ স্কুল, মসজিদ ও খেলার মাঠে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের জন্য একমাত্র সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসছেন ফিলিস্তিনিরাই, যারা কম্বল, বিছানা, খাবার ও পানি সরবরাহ করছেন।
নূরদিনের ধারণা, ইসরায়েল অভিযান বন্ধ করলে বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িতে ফিরে যাবে। তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, ইসরায়েলিরা যা-ই করুক না কেন, মানুষ তাদের জন্মস্থানে ফিরে যাবে, কারণ তাদের জন্য শরণার্থী শিবির ছাড়া জীবন কাটানো অসম্ভব।”
ফাহমাউয়ি আরও যোগ করেন, শিবিরের অধিকাংশ মানুষ শহরের জীবনযাত্রার খরচ বহন করতে পারে না। তাই ইসরায়েল তাদের ভয় দেখানোর জন্য সেখানে অবস্থান শক্ত করলেও তারা নূর শামসে ফিরে যাবে। তিনি বলেন, “পুরো ফিলিস্তিনই বিপজ্জনক, শুধু শরণার্থী শিবির নয়। এখানে কোনো আইন নেই এবং ইসরায়েলি সেনারা যেকোনো সময় যেকোনো ফিলিস্তিনির ওপর গুলি চালাতে পারে। আমাদের যাওয়ার মতো আর কোনো জায়গা নেই, তাই আমাদের কোনো বিকল্পও নেই।”
অন্যদিকে, তুলনামূলকভাবে ধনী ফিলিস্তিনিদের চিন্তা ভিন্ন। জাদাল্লাহ বলেন, তার এক বন্ধু ইসরায়েলের আক্রমণের ভয়ে পরিবার নিয়ে জর্ডানে চলে গেছেন। কারণ ইসরায়েল খুব শীঘ্রই তুলকারেম, জেনিন ও রামাল্লার মতো শহরগুলোতেও শরণার্থী শিবিরের মতো হামলা চালাতে পারে। তিনি জানান, তার বন্ধু আগে জেনিন শিবিরে থাকতেন, কিন্তু ভালো রোজগার শুরু করার পর তিনি পরিবার নিয়ে জেনিন শহরে চলে যান। সম্প্রতি তারা জর্ডানে চলে গিয়ে তাদের সন্তানদের সেখানে স্কুলে ভর্তি করেছেন, কারণ জেনিন শহর এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
ফাহমাউয়ির মতে, দেশ ত্যাগ করলে ফিলিস্তিনিরা নিরাপদ থাকবে না। তিনি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট কর্তৃক ফিলিস্তিনের পিএইচডি শিক্ষার্থী মাহমুদ খলিলের আটকের কথা উল্লেখ করেন। খলিলের যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে বসবাসের অনুমতি ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন খলিলের স্থায়ী বসবাসের অনুমতি বাতিল করে দেয়, কারণ তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা নিয়ে প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
ফাহমাউয়ি বলেন, “জন্মভূমির কোনো বিকল্প নেই। শেষ পর্যন্ত আমাদের সবার যাওয়ার মতো আর কোনো জায়গা নেই। যদি আমাদের মরতে হয়, তাহলে আমরা আমাদের জমিতেই মরব।”
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা