বরফের দেশ গ্রিনল্যান্ডে: এক দুঃসাহসিক অভিযান, জলবায়ু পরিবর্তনের সতর্কবার্তা
পৃথিবীর প্রান্ত বলতেই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক শীতল, রুক্ষ আর ভয়ঙ্কর সুন্দর এক জগৎ – গ্রিনল্যান্ড। সম্প্রতি, ‘ট্রাভেল অ্যান্ড লেজার’-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, আটলান্টিক মহাসাগরের কোল ঘেঁষে থাকা এই দ্বীপটিতে একদল পর্যটকের দুঃসাহসিক অভিযানের অভিজ্ঞতা। অভিযানটি ছিল পরিবেশ-বান্ধব পর্যটনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা একইসঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করে তোলে।
গ্রিনল্যান্ডের কুলুসুক গ্রাম থেকে শুরু হয় এই অভিযান। এখানকার ইনুইট সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা, প্রকৃতির সঙ্গে তাদের নিবিড় সম্পর্ক, সবকিছুই যেন অন্যরকম। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে, কায়াক নৌকায় চড়ে, পর্বতের গায়ে হেঁটে অভিযানকারীরা পৌঁছে যান এক অচেনা জগতে। রাতে তাঁবুতে থাকার সময় মেরু ভালুকের আনাগোনা ছিল এক উদ্বেগের কারণ, কারণ এখানে তারা খুবই সক্রিয়। পর্যটকদের দল পালা করে সারা রাত জেগে ভালুক পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। একইসঙ্গে তিমি মাছের গর্জন আর বাতাসের শনশন শব্দে তাঁদের মধ্যে এক মিশ্র অনুভূতির জন্ম হয় – একদিকে যেমন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য, অন্যদিকে তেমনই অজানা ভীতি। ইনুইট ভাষায় এই অনুভূতিকে ‘ইলিরা’ বলা হয়, যার অর্থ হলো “ভয় মিশ্রিত বিস্ময়”।
এই অভিযানের মূল আকর্ষণ ছিল আপুসিয়াজিক হিমবাহ (Apusiaajik Glacier)। এখানকার পরিবেশ এতটাই নাজুক যে সামান্য পরিবর্তনেই তার প্রভাব স্পষ্ট হয়। হিমবাহের বরফ দ্রুত গলতে শুরু করেছে, যা সমুদ্রের জলতল আরও বাড়িয়ে দেবে। পরিবেশ রক্ষার কথা মাথায় রেখে, অভিযাত্রীরা হেঁটে ও কায়াকিংয়ের মাধ্যমে তাঁদের যাত্রা করেন। ভারী সরঞ্জাম এবং শুকনো খাবার সরবরাহ করার জন্য মাঝে মাঝে ছোট মোটর বোটের সাহায্য নেওয়া হতো।
অভিযানে স্থানীয় গাইড হিসেবে ছিলেন ম্যাট স্পেন্সলি নামের এক ব্রিটিশ নাগরিক, যিনি ২৪ বছর আগে এখানে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন একজন ইনুইট শিকারি, যাঁর নাম জকুম হেইমার মিখায়েলসেন, যিনি ‘জাক্কু’ নামেই পরিচিত। কায়াকিং করার সময় তাঁরা বিশাল আকারের তিমি মাছের দেখা পান, যা তাঁদের অভিজ্ঞতা আরও রোমাঞ্চকর করে তোলে।
একদিন তাঁরা বরফের গুহায় প্রবেশ করেন। গুহার ভেতরের পরিবেশ ছিল অত্যন্ত শীতল এবং বিপদজনক। গাইড স্পেন্সলি জানান, সম্প্রতি আইসল্যান্ডে বরফের গুহা ধসে পড়ার ঘটনা ঘটেছে, তাই এখানকার পরিবেশ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকাটা জরুরি।
অভিযানকালে, তাঁরা ইনুইটদের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত হন। জাক্কু নামের গাইড তাঁদের জন্য মেরু ভালুকের চামড়ার পোশাক পরে, ঐতিহ্যবাহী ইনুইট ঢোল বাজিয়ে গান শোনান। রাতের আকাশে দেখা যায় উত্তর মেরুর আলো, যা সবুজ আভা ছড়িয়ে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের সৃষ্টি করে।
গ্রিনল্যান্ডের এই অভিযান শুধু প্রকৃতির অনবদ্য রূপ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ ছিল না, বরং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কেও সচেতন করেছে। এখানকার বরফ দ্রুত গলে যাওয়ায় সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে, যা বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য এক মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। গ্রিনল্যান্ডের অভিজ্ঞতা তাই আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা, যা পরিবেশ সুরক্ষার গুরুত্ব আরও একবার মনে করিয়ে দেয়।
তথ্য সূত্র: ট্রাভেল অ্যান্ড লেজার