যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে পুতিনের শর্ত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের প্রতিক্রিয়া
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে মুখ খুলেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তবে তিনি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে উত্থাপিত এই প্রস্তাবে মস্কো নীতিগতভাবে রাজি হলেও, কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। বৃহস্পতিবার (গতকাল) এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেন।
পুতিন বলেন, রাশিয়া এই প্রস্তাবের শর্তগুলো নিয়ে আলোচনা করতে চায়। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করে শান্তি প্রস্তাবের শর্তগুলো চূড়ান্ত করতে হবে। তার এই মন্তব্যের পর ইউক্রেন তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে এসেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
জানা গেছে, গত মঙ্গলবার সৌদি আরবের জেদ্দায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের প্রতিনিধি দলের মধ্যে শান্তি আলোচনার একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের পর দেশ দুটি একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে, যেখানে যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রস্তাবে দুপক্ষের মধ্যে ‘অবিলম্বে, অন্তর্বর্তীকালীন’ ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়।
বিবৃতিতে, যুদ্ধবিরতি চলাকালীন সময়ে ‘যুদ্ধবন্দীদের বিনিময়, বেসামরিক বন্দিদের মুক্তি এবং জোরপূর্বক স্থানান্তরিত ইউক্রেনীয় শিশুদের ফিরিয়ে আনার’ ওপর জোর দেওয়া হয়। তবে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা অথবা ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিষয়ে কোনো কথা উল্লেখ করা হয়নি। তবে এতে বলা হয়, ইউক্রেনের ইউরোপীয় মিত্ররা ‘শান্তি প্রক্রিয়ায় জড়িত’ থাকবে।
পুতিন বৃহস্পতিবার বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর সঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিষয়ে কথা বলেন। তিনি জানান, যুদ্ধবিরতির ধারণাটি ‘সঠিক’ এবং রাশিয়া নীতিগতভাবে এর সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, “আমরা যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত।”
তবে তিনি আরও যোগ করেন, “এখানে কিছু বিষয় রয়েছে যা নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। আমার মনে হয়, আমাদের আমেরিকান সহযোগী ও অংশীদারদের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলা দরকার। সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি আলোচনা করা যেতে পারে।”
রুশ প্রেসিডেন্ট তিনটি প্রশ্ন উত্থাপন করেন এবং জানান, এই বিষয়গুলোর সন্তোষজনক সমাধান হলেই কেবল ক্রেমলিন যুদ্ধবিরতি মেনে নেবে।
পুতিনের প্রথম প্রশ্নটি হলো, রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে থাকা ইউক্রেনীয় সৈন্যদের নিয়ে। গত বছর আগস্টে ইউক্রেনীয় বাহিনী আকস্মিকভাবে কুরস্কে প্রবেশ করে কিছু এলাকা দখল করে নেয়। যদিও রুশ বাহিনী বর্তমানে কুরস্কের ১,১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা পুনরুদ্ধার করেছে, তবে এখনো কিছু ইউক্রেনীয় সৈন্য সেখানে রয়েছে।
পুতিন জানতে চান, “সেখানে থাকা সবাই কি যুদ্ধ ছাড়াই এলাকা ছেড়ে চলে যাবে? নাকি ইউক্রেনীয় নেতৃত্ব তাদের অস্ত্র সমর্পণ করতে নির্দেশ দেবে?”
পুতিন আরও বলেন, ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি ইউক্রেনকে নতুন সেনা সমাবেশ করার সুযোগ করে দিতে পারে। কারণ বর্তমানে ইউক্রেনীয় সেনারা কেবল কুরস্কেই নয়, পূর্বাঞ্চলেও পিছিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি রাশিয়া ধীরে ধীরে সেখানে তাদের অবস্থান আরও শক্ত করছে।
সংবাদ সম্মেলনে পুতিন বলেন, “ফ্রন্টের প্রায় সব এলাকাতেই রুশ সেনারা এগিয়ে যাচ্ছে… তাহলে এই ৩০ দিন কীভাবে ব্যবহার করা হবে? ইউক্রেনে কি তখন নতুন করে সেনা সমাবেশ ও অস্ত্র সরবরাহ চলবে? নতুন করে একত্রিত হওয়া সেনাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে? কিভাবে নিশ্চিত করা হবে যে এমনটা ঘটবে না? কিভাবে এর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা হবে?”
পুতিনের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ইউরি উসাকভও বৃহস্পতিবার জানান, ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি ইউক্রেনীয় সৈন্যদের পুনরায় সংগঠিত হতে সাহায্য করবে। তিনি যুদ্ধবিরতিকে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর জন্য একটি ‘অস্থায়ী বিশ্রাম’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে, ইউক্রেন বর্তমানে জনবল সংকটে ভুগছে। জানুয়ারিতে ইউক্রেনীয় সেনারা ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলের ল look at Kurakhove শহর থেকে পিছু হটে, যখন রুশ বাহিনী শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেয়।
পুতিন যুদ্ধবিরতি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে এবং উভয় পক্ষ চুক্তি মানছে কিনা, তা কে নিশ্চিত করবে, সেই বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, “আমরা ধরে নিচ্ছি, এই যুদ্ধবিরতি দীর্ঘমেয়াদী শান্তি আনবে এবং এই সংকট সৃষ্টির মূল কারণগুলো দূর করবে।”
তিনি আরও বলেন, “যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ কে দেবে? … কে নির্ধারণ করবে, কোথায় এবং কে সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে? কারণ যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি ২,০০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে কার্যকর হবে।”
পুতিনের এই মন্তব্যের কিছুক্ষণ আগে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ রাশিয়া সফর করেন এবং পুতিনসহ অন্যান্য রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যদিও উইটকফ আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত, তবে তিনি রাশিয়া সম্পর্ক বিষয়ক কাজেও জড়িত।
গত মাসে তিনি ছিলেন ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর রাশিয়া সফর করা প্রথম উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন কর্মকর্তা। এই সফরে তিনি কারারুদ্ধ আমেরিকান মার্ক ফোগেলের মুক্তির বিনিময়ে রুশ নাগরিক আলেকজান্ডার ভিনিকের মুক্তি নিশ্চিত করেন। উইটকফ সৌদি আরবে রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায়ও মার্কিন দলের অংশ ছিলেন।
বৃহস্পতিবার ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটের সঙ্গে বৈঠকের শুরুতে ট্রাম্প বলেন, পুতিনের বক্তব্য ‘খুবই আশাব্যঞ্জক, তবে তা সম্পূর্ণ নয়’। “এখন আমরা দেখব রাশিয়া কি তাদের কথায় অটল থাকে, নাকি থাকে না। যদি তারা তা না করে, তবে এটি বিশ্ববাসীর জন্য খুবই হতাশাজনক মুহূর্ত হবে।”
একই দিনে, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট সিএনবিসিকে বলেন, ট্রাম্প ‘উভয় পক্ষের ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করতে প্রস্তুত’, যার মধ্যে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপও অন্তর্ভুক্ত।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়ার ওপর অন্তত ২১,৬৯২টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যার লক্ষ্য ব্যক্তি, গণমাধ্যম সংস্থা, সামরিক খাত, জ্বালানি খাত, বিমান চলাচল, জাহাজ নির্মাণ এবং টেলিযোগাযোগসহ বিভিন্ন খাত।
গত সপ্তাহে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা ও গোয়েন্দা তথ্য দেওয়া সাময়িকভাবে স্থগিত করে। ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকের ফলশ্রুতিতে এমনটা হয়। পরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে জেদ্দায় ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর সামরিক সহায়তা ও গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান পুনর্বহাল করা হয়।
বৃহস্পতিবার রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া এক বার্তায় জেলেনস্কি বলেন, পুতিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ‘প্রত্যাখ্যানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন’।
কিং’স কলেজ লন্ডনের প্রতিরক্ষা অধ্যয়ন বিভাগের পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক মারিনা মিরন বলেন, রাশিয়ার জন্য যুদ্ধবিরতি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব করাটা স্বাভাবিক।
মিরন বলেন, “যুদ্ধবিরতি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত এবং সবাই একই অবস্থানে না আসা পর্যন্ত সময় লাগবে, যা সম্ভবত রাশিয়াকে কুরস্ক পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় সময় দেবে।”
জেলেনস্কি তার বার্তায় আরও যোগ করেন, “এখন তার [পুতিনের] ওপর চাপ বাড়ানোর সময় এসেছে। এমন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে যা কাজ করবে।” ইউক্রেনীয় নেতা বলেন, শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও এগিয়ে নিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা