পুরুষরা কেন হিল জুতা পরা বন্ধ করে দিল? ফ্যাশন জগতের এই পরিবর্তনের পেছনের গল্প
প্যারিস ফ্যাশন উইকে র্যাম্পে পুরুষ মডেলদের হিল পরে হেঁটে আসার দৃশ্য অথবা র্যাপার ও অভিনেতা জেইডেন স্মিথকে লুই ভিটনের অনুষ্ঠানে উঁচু হিলের লোফার পরতে দেখা যেতে পারে। এই দৃশ্য হয়তো অনেকের কাছে আধুনিক ফ্যাশনের অগ্রগতির প্রতীক, কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন হিল জুতা পুরুষদের ফ্যাশনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল।
মহিলাদের হিল জুতার সঙ্গে সম্পর্ক সপ্তদশ শতাব্দি থেকে, যখন এটি সম্পদশালী নারীদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নেয়, কারণ হিল পরলে পা ছোট ও সুগঠিত দেখায়। তবে এর আগে, হিল জুতা ছিল পুরুষদের একচেটিয়া ফ্যাশন। এটি পুরুষত্বের প্রতীক এবং উচ্চ সামাজিক মর্যাদার পরিচায়ক ছিল।
বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে, গ্ল্যাম রক সঙ্গীত হিলকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করলেও, শারীরিক উচ্চতা বাড়াতে চাওয়া পুরুষরা প্রায়ই গোপনে তাদের জুতার ভেতরে বিশেষ ব্যবস্থা নিতেন।
আজকাল, লাল কার্পেট এবং র্যাম্পে হিল পরিহিত পুরুষদের দেখা যায়, যা প্রচলিত লিঙ্গ ধারণার পরিবর্তন হিসেবে বিবেচিত হয়। ফ্যাশন ডিজাইনার রিক ওভেন্সের স্বচ্ছ হিলের ‘কিস’ প্ল্যাটফর্ম বুট, অভিনেতা জ্যারেড লেটোর ডিস্কো-স্টাইলের সাদা বা সোনালি হিল অথবা সঙ্গীতশিল্পী প্রিন্সের সজ্জিত বুটিগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে এখনো কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে অভিনেতা বিলি পোর্টার যখন জিমি চু-র সঙ্গে মিলে জেন্ডার-ইনক্লুসিভ হিলের একটি সংগ্রহ প্রকাশ করেন, তখন সীমিত সংখ্যক ব্র্যান্ড এই ধরনের জুতা তৈরি করায় তিনি পরিচিতি পান।
যুক্তিযুক্ত উচ্চতা এখনো সমাজে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হয়। ডেটিং অ্যাপগুলিতে উচ্চতা উল্লেখ করা হয়, এমনকি কেউ কেউ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পায়ের উচ্চতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। এমতাবস্থায়, প্রশ্ন জাগে— কেন হিল জুতা আজও সব লিঙ্গের মানুষের কাছে এত জনপ্রিয় নয়?
টরন্টোর বাটা শু মিউজিয়ামের প্রধান কিউরেটর এলিজাবেথ সেমেলহ্যাকের মতে, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে জ্ঞানদীপ্তির সময় মানুষের ধারণাগুলোর পরিবর্তন হয়। এই সময়ে দার্শনিকরা বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক শ্রেণির মানুষের মধ্যে কিছু মিল খুঁজে পান, তবে লিঙ্গ বিভাজন বেড়ে যায়। পুরুষদের সক্রিয় এবং নারীদের শোভা বর্ধনের উপকরণ হিসেবে দেখা হতো। সেমেলহ্যাকের মতে, “আমরা আজও লিঙ্গের এই ধারণাগুলো অনুভব করি।”
হিলের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, দশম শতকে পশ্চিম এশিয়ায় ঘোড়ার আরোহীদের জন্য হিলের ব্যবহার শুরু হয়েছিল, যা তাদের জুতাকে ঘোড়ার রেকাবের সঙ্গে আটকে রাখতে সাহায্য করত। এরপর, ষোড়শ শতকে পারস্যের সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যমে হিল ইউরোপে প্রবেশ করে।
সেমেলহ্যাক ব্যাখ্যা করেন, “হিলের ধারণা অশ্বারোহণ এবং ইউরোপীয়দের চোখে পুরুষত্বের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাই এটি পশ্চিমা বিশ্বে জুতার ফ্যাশনে প্রবেশ করে।”
সপ্তদশ শতকে, ধনী ইউরোপীয় পুরুষরা দুই ধরনের হিল পরতেন: চামড়ার স্তূপ করা হিল (যা সাধারণত ঘোড়ার বুটে দেখা যেত) এবং চামড়া দিয়ে মোড়া হিল (যা রাজকীয় স্টাইলের জন্য ব্যবহৃত হতো)। চামড়া দিয়ে মোড়া হিল পরে নারীরা স্টাইল তৈরি করতে শুরু করে, যা আজকের স্টিলেটো এবং কিটেন হিলের মতো। অন্যদিকে, চামড়ার স্তূপ করা হিল কাউবয় বুট এবং সাধারণ জুতার ফ্যাশনে এখনো জনপ্রিয়। সেসময়, উঁচু হিল পুরুষদের উচ্চ সামাজিক মর্যাদা নির্দেশ করত, কারণ এগুলো দীর্ঘ সময় ধরে হাঁটা বা শ্রমসাধ্য কাজের জন্য উপযুক্ত ছিল না।
পুরুষদের জন্য অলঙ্কৃত হিলের একটি বিখ্যাত চিত্র হলো ১৭০১ সালে আঁকা চতুর্থ লুইয়ের প্রতিকৃতি, যেখানে ফরাসি এই রাজার সোনালী ও নীল লিলি ফুলের পোশাক এবং সাদা মোজার সঙ্গে লাল হিলের জুতা দেখা যায়।
ফরাসি ভাষায় ‘লে তালন রুজ’ নামে পরিচিত লাল হিল ছিল রাজকীয় মর্যাদার প্রতীক, যা রাজা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু অভিজাতদের জন্য সীমাবদ্ধ করেছিলেন। সেই সময়ের অন্যান্য ছবিতে দেখা যায়, অভিজাত মহিলারা তাদের পোশাকের কারণে জুতা প্রায় ঢেকে রাখতেন, যেখানে পুরুষরা তাদের হিল দেখানোর জন্য পা প্রসারিত করতেন। কয়েক শতাব্দী পরে, ফরাসি ডিজাইনার ক্রিশ্চিয়ান লুবুতাঁ-র লাল রঙের সোলযুক্ত জুতাও একই ধরনের বিলাসবহুল প্রভাব তৈরি করতে বাজারজাত করা হয়।
আজকের দিনে পুরুষদের উচ্চতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হলেও, হিলের জনপ্রিয়তার পেছনে এটি একমাত্র কারণ ছিল না। সেমেলহ্যাকের মতে, উচ্চতা এবং পুরুষত্ব তখনো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। নারীদের হিল পরার কারণ ছিল “ছোট পায়ের” নতুন সৌন্দর্য ধারণা। তিনি বলেন, “উঁচু হিল নারীদের ফ্যাশনের একটি অংশ হয়ে ওঠে, যা তাদের পায়ের পাতা উপরে তুলে ধরে এবং পায়ের আকার ছোট দেখায়। হিলের অবস্থান এমনভাবে তৈরি করা হতো, যাতে তারা খুব ছোট পায়ের ছাপ রাখতে পারে।”
চামড়া দিয়ে মোড়া হিল যখন পুরুষদের ফ্যাশন থেকে হারিয়ে যায়, তখন তা আর ফিরে আসেনি। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে, পশ্চিমা বিশ্বে পুরুষদের পোশাকে পরিবর্তন আসে, যা ‘মহান পুরুষ বর্জন’ নামে পরিচিত। পুরুষরা উজ্জ্বল রং, জমকালো পোশাক এবং অতিরিক্ত অলঙ্কার ত্যাগ করে, যা তাদের পোশাককে আরও বাস্তবসম্মত করে তোলে। এর পাশাপাশি, তাদের হিলের উচ্চতাও কমে আসে। নারীদের হিলের উচ্চতা, যদিও, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে জড়িত ছিল।
পুরুষদের হিল পরা এখনো কিছুটা কঠিন। সেমেলহ্যাক মনে করেন, “অনেকে এটাকে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ফ্যাশন হিসেবে দেখেন, তবে এটা কি সত্যিই তাই, নাকি অতীতের পুরুষ ফ্যাশনের পুনরুদ্ধার?”
তথ্য সূত্র: সিএনএন