পোষা গোল্ডফিশ, যারা দেখতে নিরীহ, তারা যদি পুকুর বা নদীতে ছাড়া হয়, তবে পরিবেশের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনতে পারে। সম্প্রতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মৎস্য ও বন্যপ্রাণী পরিষেবা (U.S. Fish and Wildlife Service) তাদের সামাজিক মাধ্যমে এই বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছে।
এই সাধারণ দৃশ্যমান মাছগুলো, যা “মি. বাবল গাপ্পি” নামে পরিচিত, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে একটি বিশাল আকারের প্রাণীতে পরিণত হতে পারে, যা বাস্তুতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে।
সাধারণত, হাতের তালুতে ধরে রাখা যায় এমন আকারের গোল্ডফিশ পাওয়া গেলেও, বন্য পরিবেশে পাওয়া কিছু গোল্ডফিশের ওজন প্রায় ১.৮ কিলোগ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। যা একটি মাঝারি আকারের বিড়ালের সমান। এই বিশাল আকারের গোল্ডফিশগুলোকেই মজা করে “মেগালাডন” (প্রাচীন বিলুপ্ত হাঙ্গরের নামানুসারে) ডাকা হয়।
গোল্ডফিশ, বৈজ্ঞানিক নাম *Carassius auratus*, প্রায় ১০০০ বছর আগে চীনে পোষা প্রাণী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। উনিশ শতকের শেষের দিকে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বেশ জনপ্রিয় হয়। কিন্তু বর্তমানে অনেকেই শখ মেটানোর পর অথবা ভালো কাজ করার ধারণা থেকে এই মাছগুলোকে উন্মুক্ত জলাশয়ে ছেড়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের লেক এরিতে এমন একটি “মেগালাডন” গোল্ডফিশ পাওয়া গেছে। এছাড়া, গ্রেট লেক সহ বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে পোতাশ্রয় ও উপসাগরের কাছাকাছি এদের আধিক্য দেখা যায়। এর প্রধান কারণ হলো পোষা গোল্ডফিশদের মুক্তি এবং তাদের প্রজনন ক্ষমতা।
বর্তমানে আলাস্কা বাদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি রাজ্যেই বন্য গোল্ডফিশের দেখা মেলে। এদের উজ্জ্বল কমলা রঙ দেখে মনে হতে পারে স্থানীয় মাছেরা এদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করবে, কিন্তু অনেক শিকারী মাছই এদের গ্রাস করতে পারে না। কানাডার মৎস্য ও সমুদ্র বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একজন জীববিজ্ঞানী ক্রিস্টিন বোস্টন জানান, “পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার পেলে গোল্ডফিশ খুব দ্রুত বাড়ে, বিশেষ করে যখন তাদের কোনো প্রধান শিকারী থাকে না।
সহজ ভাষায়, তারা এত বড় হয়ে যায় যে গ্রেট লেকের অন্যান্য মাছ বা শিকারী প্রাণীর পক্ষে তাদের শিকার করা কঠিন হয়ে পড়ে।
গোল্ডফিশ এত বড় হয় কীভাবে? তাইওয়ানের Academia Sinica-র একজন প্রাণিবিদ কিনয়া ওটা বলেছেন, বেশি খাবার খেলে মাছের বৃদ্ধি দ্রুত হয়, তবে গোল্ডফিশের কিছু বিশেষ জিনগত বৈশিষ্ট্যও রয়েছে যা তাদের আকারে বড় হতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, যে গোল্ডফিশগুলোকে উচ্চ প্রোটিন ও ফ্যাটযুক্ত খাবার দেওয়া হয়েছে, তারা দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করেছে। তার মানে, বন্য পরিবেশে বেশি পুষ্টিকর খাবার পেলে তারা বিশাল আকার ধারণ করতে পারে।
গোল্ডফিশ যে বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা স্থানীয় মাছের ডিম, লার্ভা এমনকি অন্যান্য বয়স্ক মাছও খেয়ে ফেলে। এর ফলে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের সংখ্যা কমে যায়। এছাড়াও, তারা জলজ পোকামাকড়েরও ক্ষতি করে। গোল্ডফিশ বছরে একাধিকবার প্রজনন করতে পারে, ফলে তাদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে।
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, গোল্ডফিশ জলজ উদ্ভিদের কণা ওপরে তুলে জল ঘোলা করে দেয়। এর ফলে পানিতে সূর্যের আলো প্রবেশে বাধা সৃষ্টি হয়, যা জলজ উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। এছাড়াও, গোল্ডফিশের অন্ত্রের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় ক্ষতিকর সায়ানোব্যাকটেরিয়া বেড়ে ওঠে, যা জলের গুণগত মান আরও কমিয়ে দেয়।
জলবায়ু পরিবর্তনও গোল্ডফিশের জন্য সহায়ক হতে পারে। ক্রিস্টিন বোস্টন জানিয়েছেন, “অন্যান্য মাছ যেখানে বাঁচতে পারে না, সেখানেও গোল্ডফিশ টিকে থাকতে পারে, কারণ তারা তাপমাত্রা ও অক্সিজেনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে।
উষ্ণ জলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়, তাই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যদি জল গরম হতে থাকে, তবে গোল্ডফিশ স্থানীয় প্রজাতির থেকে সুবিধা পেতে পারে।
বোস্টন এবং তার দল ২০২১ সালে একটি পুকুর থেকে ২০,০০০ গোল্ডফিশ অপসারণ করেছিলেন। কিন্তু এক বছর পর দেখা যায়, সেখানে আবার প্রায় ১০,০০০ গোল্ডফিশের জন্ম হয়েছে। তাই, আপনার পোষা গোল্ডফিশটিকে মুক্ত করার আগে, অন্য কোনো আশ্রয় খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক