শিরোনাম: খাদ্য সহায়তা হ্রাসে সংকটে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির, বাড়ছে দুর্ভিক্ষের শঙ্কা
জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সতর্ক করে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশের খাদ্য সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্তে বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বিশ্বের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের ওপর, বিশেষ করে শরণার্থী শিবিরগুলোতে। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে খাদ্য সহায়তা কমে যাওয়ায় সেখানকার পরিস্থিতি গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে খাদ্য সহায়তা খাতে ৮৩ শতাংশ অর্থ কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণার পর জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (World Food Programme – WFP) সোমালিয়াতে তাদের সহায়তা কার্যক্রম কমাতে বাধ্য হয়েছে। এর ফলস্বরূপ, গত মাসেই ধারণা করা হচ্ছে, খরা, বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধি এবং সংঘাতের কারণে এপ্রিল মাস থেকে পূর্ব আফ্রিকার দেশটিতে প্রায় ৪৪ লক্ষ মানুষ অপুষ্টির শিকার হবে।
শুধু সোমালিয়া নয়, খাদ্য সহায়তা কমানোর এই সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবনযাত্রায়ও মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) এরই মধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য খাদ্য সহায়তা অর্ধেক করে দিয়েছে। এছাড়া, কেনিয়ার শরণার্থী শিবিরেও একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে সেখানে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর আশঙ্কা, খাদ্য সংকটের কারণে অপুষ্টির শিকার শিশুদের চিকিৎসা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা কার্যক্রমগুলোও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (Food and Agriculture Organization – FAO) হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৩৬ মিলিয়ন মানুষ তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে, যাদের মধ্যে ১ কোটির বেশি মানুষের অবস্থা খুবই গুরুতর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্য সহায়তার এই সংকট দীর্ঘমেয়াদে অপুষ্টির হার বাড়াবে এবং অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়বে। উন্নয়ন সংস্থা ‘গ্লোবাল ওয়াশিংটন’-এর পরিচালক এলিজাবেথ ক্যাম্পবেল বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র একসময় খাদ্যসহায়তা খাতে সবচেয়ে বেশি অর্থ দিতো, যা অন্যান্য সব দেশের মিলিত সহায়তার চেয়েও বেশি ছিল। সেই ঘাটতি পূরণ করার মতো সামর্থ্য অন্য কোনো দেশ বা সংস্থার নেই, অন্তত স্বল্প সময়ে তো নয়ই।”
খাদ্য সহায়তা কমানোর পাশাপাশি, উন্নত দেশগুলো এখন সামরিক খাতে ব্যয় অনেক বাড়াচ্ছে। যুক্তরাজ্য তাদের জাতীয় আয়ের ০.৫৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছে, যা প্রায় ৬ বিলিয়ন পাউন্ডের সমান। জার্মানির মতো দেশও সামরিক খাতে ব্যয় বাড়াতে চাইছে, যা উদ্বেগের কারণ।
জাতিসংঘের জরুরি বিভাগের পরিচালক রেইন পলসেন জানিয়েছেন, বর্তমানে খাদ্য সহায়তা সীমিত আকারে কেবল জরুরি পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, “প্রায় ২০ কোটি মানুষ মারাত্মক খাদ্য সংকটের শিকার, যাদের সামান্য ধাক্কাতেই চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে যে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, তা মূলত কয়েক সপ্তাহ বা মাসের জন্য মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে।”
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে খাদ্য সহায়তা কমে যাওয়ায় সেখানকার শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। খাদ্য সংকটের কারণে অনেক পরিবার এখন খাদ্য কেনার জন্য ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে, যা তাদের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলেছে। অপুষ্টির শিকার শিশুদের মৃত্যুহারও বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খাদ্য সহায়তা কমানোর এই সিদ্ধান্তের ফলে খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসতে পারে। গত দুই দশকে খাদ্য সহায়তা সরাসরি বিতরণের পরিবর্তে নগদ অর্থ প্রদানের দিকে জোর দেওয়া হয়েছে। এর ফলে মানুষ স্থানীয় বাজার থেকে খাদ্য কিনতে পারছে, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (WFP) খাদ্য সহায়তার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি এখন নগদ অর্থে পরিশোধ করা হয়, যা ২০২৩ সালে ছিল প্রায় ২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
জাতিসংঘ ২০২৩ সালের মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের জন্য ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আবেদন জানিয়েছে, যার এক-তৃতীয়াংশ প্রয়োজন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ না নিলে, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান