ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় নারী ও শিশুসহ নিহত হয়েছেন অন্তত ৩২ জন, আহত হয়েছেন ১০১ জন। শনিবার থেকে শুরু হওয়া এই হামলা রবিবার পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত জাহাজে হুতি বিদ্রোহীদের হামলার হুমকির প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই হামলার নির্দেশ দেন। গাজায় ইসরায়েলের অবরোধের প্রতিবাদে হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে নৌযান লক্ষ্য করে হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছিল।
এখন পর্যন্ত ৪০টির বেশি স্থানে বোমা হামলা হয়েছে, যার অধিকাংশই ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলীয় সা’দা প্রদেশে চালানো হয়েছে। ইয়েমেনি গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, রাজধানী সানার উত্তরে অবস্থিত সা’দা প্রদেশ সহ বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী।
হুতি বিদ্রোহীরা ‘আনসার আল্লাহ’ নামেও পরিচিত। এই গোষ্ঠীটি ইয়েমেনের অধিকাংশ এলাকা, বিশেষ করে রাজধানী সানা এবং সৌদি আরবের কাছাকাছি পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করে।
১৯৯০ এর দশকে তাদের উত্থান হলেও ২০১৪ সালে তারা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে, যখন তারা তৎকালীন ইয়েমেন সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এর ফলস্বরূপ দেশটিতে ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি হয়।
এরপর ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা দীর্ঘদিন ধরে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, শিয়া এই গোষ্ঠীটিকে সরাসরি ইরানের প্রতিনিধি হিসেবে দেখা উচিত নয়, কারণ তাদের নিজস্ব ভিত্তি, স্বার্থ ও লক্ষ্য রয়েছে।
বর্তমানে হুতিরা ইয়েমেনের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে, যার মধ্যে রাজধানী সানাও অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, ইয়েমেন সরকার দেশটির দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে, এবং তাদের অস্থায়ী রাজধানী হলো আদেন।
গাজা উপত্যকার উপর ইসরায়েলের অবরোধের কারণে হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত জাহাজগুলোর উপর হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে। এরপরই এই হামলাগুলো চালানো হয়।
যদিও তারা এখনো পর্যন্ত কোনো জাহাজে হামলা চালায়নি। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস থেকে হুতি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের উপকূলের কাছে বেশ কয়েকটি জাহাজে আক্রমণ চালিয়েছে।
গোষ্ঠীটি দাবি করে যে, গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের কারণে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানাতেই তারা এই হামলাগুলো চালাচ্ছে।
পেন্টাগনের মুখপাত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল থেকে হুতি বিদ্রোহীরা যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজগুলোর উপর ১৭৪ বার এবং বাণিজ্যিক জাহাজের উপর ১৪৫ বার হামলা চালিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন কার্যক্রমের তত্ত্বাবধানকারী মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড শনিবারের হামলাকে ‘ইয়েমেনে বৃহত্তর অভিযানের সূচনা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
কর্মকর্তাদের মতে, লোহিত সাগরে অবস্থান করা ‘হ্যারি এস ট্রুম্যান’ বিমানবাহী রণতরী থেকে যুদ্ধবিমানগুলো এই হামলায় অংশ নেয়।
এর আগে, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য হুতি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বেশ কয়েকটি হামলা চালায়। তাদের দাবি ছিল, এসব হামলা ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের উদ্দেশ্যে চালানো হয়েছিল।
ইসরায়েলও বিভিন্ন সময় ইয়েমেনের অবকাঠামো, যেমন – সানার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপর হামলা চালিয়েছে।
লোহিত সাগর একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পথ, যেখান দিয়ে বিশ্বের মোট বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ সম্পন্ন হয়। সুয়েজ খাল ও বাব-el-মান্দেব প্রণালী হলো উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে জ্বালানি তেল পরিবহনের প্রধান পথ।
এই দুটি পথ দিয়ে সমুদ্রপথে বিশ্বের মোট বাণিজ্যিকভাবে পরিবহনকৃত তেলের প্রায় ১২ শতাংশ এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ৮ শতাংশ সরবরাহ করা হয়।
২০২৩ সালে বাব-el-মান্দেব প্রণালী দিয়ে দৈনিক প্রায় ৮.৮ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এবং ৪.১ বিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি পরিবহন করা হয়েছে। যা বৈশ্বিক জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লোহিত সাগরের বিকল্প হিসেবে আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত ‘কেপ অফ গুড হোপ’ ঘুরে জাহাজ চলাচল করতে হয়। তবে এই পথে ভ্রমণ অনেক বেশি সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল, বিশেষ করে উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা