মানবদেহে শূকরের হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপনের সম্ভবনা, অঙ্গ-সংকটের সমাধানে নতুন দিগন্ত?
বিশ্বজুড়ে যখন মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় অঙ্গের অভাব তীব্র, তখন বিজ্ঞানীরা এক যুগান্তকারী উদ্ভাবনের পথে এগিয়ে চলেছেন। ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসক ডাক্তার মুহাম্মদ মনসুর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে একদল গবেষক শূকরের হৃদপিণ্ডকে মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপনের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছেন। এই গবেষণা যদি সফল হয়, তবে তা মানবদেহে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং সারা বিশ্বের রোগীদের জন্য জীবন বাঁচানোর সুযোগ তৈরি করবে।
ডাক্তার মহিউদ্দিন এবং তার দল ইতিমধ্যে এই পদ্ধতিতে দুটি সফল অস্ত্রোপচার করেছেন। ২০২২ সালে ডেভিড বেনেট সিনিয়র নামের এক রোগীর শরীরে প্রথম শূকরের হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়। মারাত্মক হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে প্রচলিত পদ্ধতিতে হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের সুযোগ ছিল না তার। অস্ত্রোপচার সফল হলেও, দুই মাস পর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে বেনেটের মৃত্যু হয়।
এরপর ২০২৩ সালে লরেন্স ফসেট নামের আরেকজন রোগীর শরীরে শূকরের হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়। তিনিও অস্ত্রোপচারের প্রায় ৪০ দিন পর একই কারণে মারা যান।
যদিও দুটি পরীক্ষাই সফলতার মুখ দেখেনি, তবে এই প্রক্রিয়াগুলো ডাক্তার মহিউদ্দিন এবং তার দলকে মূল্যবান তথ্য দিয়েছে। এই অভিজ্ঞতাগুলোর মাধ্যমে তারা বুঝতে পেরেছেন, কীভাবে শূকরের হৃদপিণ্ডকে মানুষের শরীরের সঙ্গে আরও ভালোভাবে মানিয়ে নেওয়া যায়।
এই গবেষণার মূল ভিত্তি হলো ‘জেনোট্রান্সপ্লান্টেশন’ – অর্থাৎ, এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রাণীর শরীরে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা। ডাক্তার মহিউদ্দিন এই ক্ষেত্রে একজন অগ্রণী গবেষক এবং শূকরের হৃদপিণ্ড মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপনের বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিত। তিনি জানান, প্রথমে তারা ইঁদুরের শরীরে ছুঁচোর হৃদপিণ্ড, এরপর ইঁদুরের শরীরে ইঁদুরের হৃদপিণ্ড এবং বানরের শরীরে শূকরের হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করেন।
বানর ও শিম্পাঞ্জির ডিএনএ মানুষের কাছাকাছি হলেও, এই দুটি প্রাণীর শরীরে এইডস-এর মতো রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি ছিল। এছাড়াও, বানরের হৃদপিণ্ড মানুষের জন্য উপযুক্ত হতে অনেক বেশি সময় নিতো।
শূকর নির্বাচনের কারণ সম্পর্কে ডাক্তার মহিউদ্দিন বলেন, শূকর খুব দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে এবং এদের শরীরে জিনগত পরিবর্তন করা সহজ। একটি শূকরীর গড়ে ১০টি বাচ্চা হয়, যা গবেষণার জন্য অনেক বেশি সুবিধা নিয়ে আসে। শূকরের শারীরবৃত্তীয় গঠন মানুষের থেকে আলাদা হলেও, জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের অঙ্গ মানুষের শরীরের উপযোগী করে তোলা সম্ভব।
এই প্রক্রিয়ায় শূকরের প্রায় ৩০,০০০ জিনের মধ্যে মাত্র ১০টিকে পরিবর্তন করা হয়। এর মাধ্যমে প্রধানত শূকরের হৃদপিণ্ডকে মানুষের শরীর প্রত্যাখ্যান করতে বাধা দেওয়া হয় এবং হৃদপিণ্ডের অতিরিক্ত বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
এক্ষেত্রে, শূকরের অঙ্গ ব্যবহার করা কতটা নৈতিক, সেই বিষয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। তবে ডাক্তার মহিউদ্দিনের মতে, “যখন জীবন বাঁচানোর প্রশ্ন আসে, তখন অন্য সব বিষয় গৌণ হয়ে যায়।”
বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় অঙ্গের সংকট একটি গুরুতর সমস্যা। উন্নত দেশগুলোতেও এই সমস্যা প্রকট। বাংলাদেশেও প্রতি বছর অনেক মানুষ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অভাবে মারা যায়। ডাক্তার মহিউদ্দিনের এই গবেষণা সফল হলে, অঙ্গ-সংকট মোকাবিলায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক