অ্যাপলের জন্য ২০২৫ সালটা বেশ কঠিন যাচ্ছে, এমনটাই প্রতীয়মান হচ্ছে। তাদের ডিজিটাল সহকারী সিরির নতুন সংস্করণ বাজারে আসার কথা থাকলেও, সেটি পিছিয়ে যাওয়ায় প্রযুক্তি বিশ্বে বেশ আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (Artificial Intelligence/AI) দৌঁড়ে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা এবং চীনের বাজারে ব্যবসার অবনতি, সব মিলিয়ে অ্যাপলের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
গত বছর জুনে, অ্যাপল তাদের সিরিকে নতুনভাবে সাজানোর ঘোষণা দেয়। তারা জানিয়েছিল, ১৩ বছর বয়সী এই ডিজিটাল সহকারী ব্যবহারকারীর ই-মেইল, টেক্সট এবং ফ্লাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করে জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে।
উদাহরণস্বরূপ, ব্যবহারকারী জানতে পারবেন তার মায়ের ফ্লাইট কখন ল্যান্ড করবে এবং দুপুরের খাবারের পরিকল্পনা কী। কিন্তু বাস্তবে, এই পরিকল্পনা এখনো অনেক দূরে।
গত ৭ই মার্চ অ্যাপল জানায়, সিরির উন্নত সংস্করণ তৈরিতে আরও বেশি সময় লাগবে, যা ব্যবহারকারীর আইফোন ডেটা ব্যবহার করে আরও ব্যক্তিগতকৃত উত্তর দিতে পারবে। এর ফলে অনেকেই মনে করছেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বাজারে অ্যাপল হয়তো পিছিয়ে পড়ছে।
ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিলম্বের কারণে সিরি বিভাগের প্রধান হতাশ এবং বিব্রত।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে ইন্টারনেটের ভবিষ্যৎ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা মানুষের কাজ, যোগাযোগ এবং তথ্য পাওয়ার পদ্ধতিকে নতুন রূপ দেবে। ২০০৭ সালে আইফোন বাজারে এনে মোবাইল প্রযুক্তির জগতে বিপ্লব ঘটিয়েছিল অ্যাপল।
এখন সবার দৃষ্টি তাদের দিকে, কারণ সবাই চাইছে তারা যেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সেও একই রকম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। কিন্তু প্রতিযোগী কোম্পানিগুলো দ্রুত নতুন মডেল, চিপ এবং এআই-চালিত ফিচার নিয়ে আসায়, অ্যাপলের জন্য সময়টা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুধু তাই নয়, চীনের সাথে বাণিজ্য নিয়েও অ্যাপলকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। চীনের বাজারে আইফোনের যন্ত্রাংশ সরবরাহ হয়, তাই শুল্কের (tariff) ঝুঁকি তাদের জন্য একটি বড় উদ্বেগের কারণ।
অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিম কুক জানিয়েছেন, তাদের আয়ের হিসাব অনুযায়ী, চীনে তাদের বিক্রি ১১ শতাংশ কমেছে। বিশ্বব্যাপী আইফোনের বিক্রিও প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি।
যদিও সামগ্রিকভাবে তাদের আয় ৪ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে, শেয়ার বাজারে অ্যাপলের শেয়ারের দাম প্রায় ১২ শতাংশ কমেছে।
তবে, সব কিছু এত হতাশাজনক নয়। প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মতে, অ্যাপলের বিশাল গ্রাহক ভিত্তি এবং আইফোনের জনপ্রিয়তা তাদের এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে। বিশ্লেষক বার্টন ক্রকেট বলেন, “স্মার্টফোন যেহেতু এখন একটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে, তাই কঠিন সময়েও অ্যাপল ভালো অবস্থানে থাকবে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বাজারে অ্যাপলের পিছিয়ে পড়া নিয়ে অনেক দিন ধরেই আলোচনা চলছে। গত বছর অক্টোবর মাসে অ্যাপল তাদের এআই ফিচারগুলো উন্মোচন করে, যেখানে কাস্টম ইমোজি তৈরি এবং সিরির মাধ্যমে চ্যাটজিপিটি (ChatGPT) ব্যবহারের সুযোগ ছিল।
কিন্তু গুগল এবং স্যামসাংয়ের মতো প্রতিযোগী কোম্পানিগুলো এর আগেই তাদের ফোনে এআই টুলস যুক্ত করেছে।
অ্যাপল গত বছর জানিয়েছিল, তারা তাদের উন্নত সিরি ফিচারগুলো ২০২৩ সালের মধ্যে বাজারে আনবে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা জানায়, এই ফিচারগুলো তৈরি করতে তাদের আরও বেশি সময় লাগবে এবং আগামী এক বছরের মধ্যে তা বাজারে আনা হবে।
অন্যদিকে, গুগল তাদের জেমিনিকে (Gemini) ব্যবহারকারীর সার্চিং হিস্টোরি অনুযায়ী কাস্টমাইজ করার সুযোগ এনেছে। অ্যামাজনও তাদের নতুন ভার্চুয়াল সহকারী অ্যালেক্সা+ (Alexa+) এনেছে, যা ব্যবহারকারীর পছন্দ মনে রাখতে পারে।
বাজার গবেষণা সংস্থা ক্রিয়েটিভ স্ট্র্যাটেজিসের প্রধান বেন বাজরিন বলেন, “অ্যাপলকে এই বাজারে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণ করতে হবে। তাদের প্রচেষ্টা এখনো দৃশ্যমান না হওয়ায়, অনেকেই উদ্বিগ্ন।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের বিলম্ব অ্যাপলের জন্য নতুন। কারণ অতীতে চীনসহ বিভিন্ন বাজারে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে তারা সফল হয়েছে। তবে, এবার এআই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তাদের কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।
স্মার্টফোনের চাহিদা আগের মতো না থাকলেও, অ্যাপল সবসময় ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকে। স্মার্টফোন এখন একটি সাধারণ পণ্যের মতো হয়ে গেছে, তাই ব্যবহারকারীরা নতুন ফিচারের চেয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী ফোন বদল করতে বেশি আগ্রহী।
স্মার্টফোন ব্যবসার পাশাপাশি, অ্যাপলকে ডিজিটাল সেবা এবং পরিধেয় যন্ত্রাংশের (wearables) মতো নতুন ব্যবসায়ও মনোযোগ দিতে হবে।
ওয়েডবুশ সিকিউরিটিজের বিশ্লেষক ড্যান আইভস-এর মতে, অ্যাপল ২০২৫ সালে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। অ্যাপলের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, যেসব বাজারে অ্যাপল ইন্টেলিজেন্স পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে আইফোনের বিক্রি ভালো হয়েছে।
তবে, সিরি’র নতুন সংস্করণ তৈরিতে বিলম্বের কারণ হতে পারে, যদি নতুন সংস্করণটি প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ না করে। গত বছর গুগলের এআই ওভারভিউ ফিচারে ভুল তথ্য দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল।
এছাড়াও, অ্যাপল সম্ভবত এই বছর আইফোনের একটি নতুন, হালকা সংস্করণ তৈরির পরিকল্পনা করছে। এর ফলে তাদের প্রধান পণ্যটির প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ বার্টন ক্রকেটের মতে, সিরির এই বিলম্ব অ্যাপলের সামগ্রিক পরিকল্পনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না। তিনি বলেন, “ভবিষ্যতে আইফোনের কার্যকারিতা আরও উন্নত হবে, যা ব্যবহারকারীদের জন্য ভালো কিছু নিয়ে আসবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন