গাজায় ইসরায়েলের নতুন করে বিমান হামলা, বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা।
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান আবারও শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে দফায় দফায় চালানো বিমান হামলায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সর্বশেষ হামলায় তিনজন নিহত হয়েছেন। গাজা শহরের সাবরা এলাকায় একটি বাড়িতে বিমান হামলা চালানো হয়।
এছাড়া, উত্তরাঞ্চলীয় শহর বেইত হানুনে হামলায় নিহত হয়েছেন আরও দুজন। আহত হয়েছেন অন্তত ছয়জন।
গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল জানিয়েছেন, মধ্যরাতের পর থেকে এ পর্যন্ত ১৩ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে গাজার দক্ষিণাঞ্চলে খান ইউনিসে বেশ কয়েকজন রয়েছেন।
ইসরায়েলি ড্রোন গাজা শহরের কাছে কয়েকটি মাছ ধরার নৌকায়ও হামলা চালিয়েছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, তারা ‘সন্ত্রাসী’ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলে হামাসের একটি সামরিক স্থাপনাও রয়েছে, যেখানে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার প্রস্তুতি চলছিল।
এছাড়া, গাজা উপকূলীয় এলাকার কয়েকটি জাহাজেও হামলা চালানো হয়েছে। হামাস ও ইসলামিক জিহাদ সশস্ত্র গোষ্ঠী এসব জাহাজকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের পরিকল্পনা করছিল।
এদিকে, বুধবার আইডিএফ গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের দক্ষিণাঞ্চলে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কারণ হিসেবে তারা ওই এলাকাকে ‘সংকটাপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
ধারণা করা হচ্ছে, গত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেওয়া এমন নির্দেশনার কারণে প্রায় ১ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হতে পারেন। এমন পরিস্থিতিতে, ইসরায়েল স্থল অভিযানের পরিকল্পনা করছে বলেও মনে করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার রাতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, এই হামলা ‘কেবল শুরু’। হামাসের সঙ্গে ভবিষ্যৎ আলোচনা ‘আগুন’ এর মধ্যেই হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় হামাস আমাদের শক্তির প্রমাণ পেয়েছে। আমি তাদের বলতে চাই, এটা কেবল শুরু।’
গত জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর গাজায় তুলনামূলকভাবে শান্তি বিরাজ করছিল। কিন্তু ইসরায়েল ও হামাস একে অপরের বিরুদ্ধে চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে।
এর আগে, গত বছরের অক্টোবর মাসে হামাসের হামলায় প্রায় ১,২০০ ইসরায়েলি নিহত হয়। এরপর গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৯,০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক।
নেতানিয়াহুসহ ইসরায়েলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হামাস যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের মেয়াদ ৩০ থেকে ৬০ দিন বাড়ানোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরেই গাজায় হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রথম ধাপের চুক্তি কার্যকর হয়েছিল জানুয়ারিতে, যা চলতি মাসের শুরুতে শেষ হয়। হামলার আগে তারা তৎকালীন ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন।
অন্যদিকে, হামাস এখনো তাদের হাতে বন্দী থাকা প্রায় ২৫০ জনের মধ্যে ৫৯ জনকে মুক্তি দেয়নি। হামাস জানিয়েছে, তারা চুক্তির তিনটি ধাপ সম্পন্ন করতে চায়।
ধারণা করা হচ্ছে, জিম্মিদের অর্ধেকের বেশি এরই মধ্যে মারা গেছেন।
ইসরায়েল অবশ্য চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে কোনো আলোচনা করতে রাজি নয়। এই ধাপে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এবং সব জিম্মিকে ফিরিয়ে আনার কথা ছিল।
একইসঙ্গে, তারা গাজায় অবরোধ কঠোর করেছে এবং বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের সময় তৈরি হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী, দ্বিতীয় ধাপ মার্চ মাসের শুরুতে শুরু হওয়ার কথা ছিল। বুধবার হামাসের একজন কর্মকর্তা তাহের আল-নুনু বলেন, ‘আলোচনার দরজা হামাস বন্ধ করেনি, তবে আমরা নতুন কোনো চুক্তির প্রয়োজনীয়তা দেখি না।’
তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি যুদ্ধ বন্ধের জন্য ‘জরুরি পদক্ষেপ’ নেওয়ার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু পার্লামেন্টে গুরুত্বপূর্ণ বাজেট ভোটের আগে তার জোট সরকারকে শক্তিশালী করতে এবং যুদ্ধবিরতির পক্ষে জনমতকে দুর্বল করতে এই হামলা শুরু করেছেন।
এছাড়া, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রধানের পদ থেকে শিন বেতের প্রধানকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভকে প্রশমিত করারও চেষ্টা করছেন তিনি।
ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও এই হামলা নিয়ে গভীর বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। নতুন করে সামরিক অভিযান শুরুর প্রতিবাদে ইতোমধ্যে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছেন।
মঙ্গলবার যুদ্ধ শুরুর প্রতিবাদ করায় পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর বল প্রয়োগ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংসদ সদস্যরা ঘটনার তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
বুধবার ভোরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানায়, সরকার কট্টরপন্থী রাজনীতিবিদ ইতামার বেন-গভিরকে জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী হিসেবে পুনর্নিয়োগের প্রস্তাব ‘ঐকমত্যের ভিত্তিতে অনুমোদন’ করেছে।
বেন-গভির জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রতিবাদে সরকার থেকে পদত্যাগ করেছিলেন, তবে যুদ্ধ পুনরায় শুরু হলে তিনি ফিরে আসার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এছাড়া, দ্বিতীয় কট্টরপন্থী মন্ত্রী হিসেবে ফিরে এসেছেন আমিচাই এলিয়াহু।
তিনি গত নভেম্বরে গাজায় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়ায় সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল অচলাবস্থা ভাঙার জন্যই হামলা শুরু করেছে। জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক ইতিহাসের অধ্যাপক ড্যানি ওর্বাখ বলেন, ‘ইসরায়েল যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে যেতে চায়নি, তার একটি বড় কারণ ছিল। এর অর্থ হতো হামাস গাজায় ক্ষমতায় থাকত এবং ইসরায়েলকে অবরোধও তুলে নিতে হতো… উভয় পক্ষের স্বার্থের মধ্যে একটি সম্পূর্ণ সংযোগহীনতা ছিল।’
এদিকে, বুধবার রাতে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সাইরেন বেজে ওঠে। আইডিএফ জানিয়েছে, ইয়েমেন থেকে একটি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছিল, যা ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সফলভাবে প্রতিহত করেছে।
গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইয়েমেন ভিত্তিক হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েল ও আন্তর্জাতিক নৌযানের ওপর হামলা চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের ওপর ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান