লন্ডনের এক সময়ের কোণঠাসা এলাকা: সৌন্দর্য ও সংস্কৃতির এক অসাধারণ আখ্যান। আশির দশকে, লন্ডনের ডালস্টন এলাকাটি আজকের মতো ঝলমলে ছিল না।
সেখানে গড়ে উঠেছিল ‘হাউস অফ বিউটি অ্যান্ড কালচার’ (House of Beauty and Culture – HOBAC) নামে একটি নকশা-সংক্রান্ত গোষ্ঠী। এই দলের সদস্যরা ছিলেন প্রায় আটজন, এবং তাঁদের কাজকর্মে ছিল এক ভিন্নতা।
ভাঙা জিনিসপত্র জোড়া দিয়ে তাঁরা তৈরি করতেন আসবাবপত্র, পোশাক, গয়না এবং শিল্পকর্ম। তাঁদের এই কাজের পেছনে একদিকে যেমন ছিল নান্দনিকতা, তেমনই ছিল আর্থিক দৈন্যতা।
দলের সদস্যদের পকেটে তেমন টাকা-পয়সা ছিল না। মার্গারেট থ্যাচারের ব্রিটেনের কঠিন সময়ে, এই দলের সৃষ্টিশীল কাজগুলি যেন এক অন্য জগৎ তৈরি করত।
এই সময়ে এইডসের (AIDS) আতঙ্কও ছিল ব্যাপক। তাঁদের তৈরি করা ব্যতিক্রমী কাজগুলি ফ্যাশন জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
শোনা যায়, বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার মার্টিন মার্গিয়েলাও (Martin Margiela) তাঁদের কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এমনকি, লুই ভিতোঁর (Louis Vuitton) একটি পুরুষদের পোশাকের প্রদর্শনীতেও তাঁদের কাজের প্রভাব দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, তাঁদের কোনো কাজই ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়াম (Victoria and Albert Museum) বা ডিজাইন মিউজিয়ামের (Design Museum) সংগ্রহশালায় স্থান পায়নি।
HOBAC-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন জন মুর (John Moore), যিনি ছিলেন জুতা প্রস্তুতকারক এবং এই দলের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁদের সঙ্গে কাজ করতেন জুডি ব্লেম (Judy Blame), যিনি ছিলেন গয়না শিল্পী ও স্টাইলিস্ট।
তিনি নেনেহ চেরি (Neneh Cherry) এবং ম্যাসিভ অ্যাটাক (Massive Attack)-এর প্রথম অ্যালবামগুলির শিল্প নির্দেশনাও দিয়েছেন। রিচার্ড টরি (Richard Torry) কাজ করতেন নিটওয়্যার নিয়ে, আর ডিজাইনার ক্রিস্টোফার নেমেথ (Christopher Nemeth) তৈরি করতেন পুরনো পোস্টাল ব্যাগ থেকে পোশাক।
তবে, এই দলের ‘ফ্রিক অ্যান্ড ফ্র্যাক’ (Frick & Frack) নামের দুই আসবাব প্রস্তুতকারক- অ্যালান ম্যাকডোনাল্ড (Alan MacDonald) এবং ফ্রিজ সলোমনকে (Fritz Solomon) নিয়ে আলোচনা হয় খুব কম।
তাঁরা তৈরি করতেন অদ্ভুত সব চেয়ার, টেবিল ও ল্যাম্প। তাঁদের তৈরি করা আসবাবপত্রের মধ্যে অন্যতম ছিল একটি টেবিল, যা তৈরি হয়েছিল রাস্তার পার্কিং-এর নিষেধাজ্ঞামূলক সাইনবোর্ড থেকে।
একবার, জনপ্রিয় শিল্পী বয় জর্জ (Boy George) ফ্রিক অ্যান্ড ফ্র্যাক-কে দুটি টেবিল ও চারটি চেয়ার তৈরির জন্য বরাত দিয়েছিলেন। চেয়ারগুলির হাতলে ডেভ বেবি (Dave Baby) নামের এক ব্যক্তি পুরুষাঙ্গের ছবি খোদাই করেছিলেন।
এই কাজের জন্য বয় জর্জকে ৪০,০০০ পাউন্ড দিতে হয়েছিল, যা আজকের দিনে প্রায় ১১,৭০০ পাউন্ডের সমান। ফ্রিক অ্যান্ড ফ্র্যাকের কাজগুলি ছিল রুক্ষ, কিন্তু তাতে কারুকার্যের কোনো অভাব ছিল না।
তাঁদের তৈরি করা আসবাবপত্র আজও অনেকের বাড়িতে শোভা পায়। প্রশ্ন হল, এই ধরনের শিল্পকর্মগুলি কি কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে? তাঁদের কাজের স্বীকৃতি কি কখনো মিলবে?
একই ধরনের কাজ করতেন অ্যান্ডি দ্য ফার্নিচার মেকার (Andy the Furniture Maker) নামে একজন শিল্পী। তিনিও ভাঙা জিনিস থেকে আসবাব তৈরি করতেন।
সম্প্রতি তাঁর ওপর তৈরি একটি তথ্যচিত্র অনলাইনে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু তাঁর কোনো কাজও ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়াম বা ডিজাইন মিউজিয়ামে দেখা যায় না।
এই গল্পগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সমাজের প্রান্তিক মানুষের সৃষ্টিশীলতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের কাজগুলি নথিভুক্ত করা এবং সংরক্ষণ করা জরুরি, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁদের সম্পর্কে জানতে পারে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান