ভাষা যখন বিপদের মুখে: কিভাবে একটি ভাষা বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানো যায়?
ভাষা মানুষের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং একটি জাতির পরিচয় ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। বর্তমানে বিশ্বে ভাষার বিলুপ্তি একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।
বিভিন্ন কারণে অনেক ভাষা আজ বিপন্ন, এবং সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ফিনল্যান্ডের ইনারি সাami ভাষা। তবে আশার আলো দেখা যাচ্ছে, কারণ ভাষাটিকে টিকিয়ে রাখতে কিছু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আর্টিক অঞ্চলের উত্তরে নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং রাশিয়ার কিছু অংশে সাami জনগোষ্ঠীর বসবাস। এদের মধ্যে ইনারি সাami’রা হলো ফিনল্যান্ডে বসবাসকারী আদিবাসী সম্প্রদায়। এক সময় এই ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা ছিল অনেক, কিন্তু কালের বিবর্তনে তা কমতে শুরু করে।
সপ্তদশ শতকে সুইডিশ শাসনের সময় থেকে এই ভাষার অবনতি শুরু হয়। এরপর ফিনল্যান্ডে বাধ্যতামূলক শিক্ষা চালু হওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। শিশুদের বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হতো এবং সেখানে তাদের সাami ভাষায় কথা বলতে দেওয়া হতো না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানকার অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হন, যার ফলে ভাষাটি আরও দুর্বল হয়ে যায়।
১৯৯০-এর দশকে ইনারি সাami ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা কমে মাত্র ৩৫০ জনে দাঁড়িয়েছিল, যাদের অধিকাংশই ছিলেন বৃদ্ধ। ভাষার এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এগিয়ে আসেন মারজা-লিসা ওলথুইস-এর মতো ভাষাবিদরা। তারা ভাষাটিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য একজোট হন।
ভাষা পুনরুদ্ধারের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, নিউজিল্যান্ডের মাওরি সম্প্রদায়ের অনুকরণে ইনারিতে প্রথম ‘ভাষা কেন্দ্র’ (Language Nest) তৈরি করা হয়, যেখানে শিশুদের সাami ভাষায় কথা বলতে উৎসাহিত করা হতো। তবে শুধু শিশুদের মাধ্যমে ভাষার বিস্তার সম্ভব ছিল না।
তাই প্রাপ্তবয়স্কদেরও এই ভাষা শেখানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
২০০৭ সালে, মারজা-লিসা ওলথুইস ইনারি সাami ভাষায় ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ফিনল্যান্ডের ভাষা গবেষণা ইনস্টিটিউটে একটি বিশেষ শিক্ষাক্রম তৈরি করেন, যার মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্কদের এই ভাষা শেখানো শুরু হয়।
এই প্রোগ্রামের নাম ছিল ‘কমপ্লিমেন্টারি আনাআর সাami ভাষা শিক্ষা’ (CASLE)। এই প্রোগ্রামের সাফল্যের ফলে আরও দুটি ভাষা কেন্দ্র খোলা হয়, এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভাষাটির চর্চা বাড়তে থাকে।
বর্তমানে, প্রায় ৫০০ জন ইনারি সাami ভাষায় কথা বলতে পারেন। ভাষার প্রসারে প্রযুক্তির ব্যবহারও বাড়ছে। ইনারি সাami ভাষার জন্য একটি ডিজিটাল বানান পরীক্ষক ও ব্যাকরণ পরীক্ষক তৈরির কাজ চলছে।
এছাড়া, উইকিপিডিয়াতেও এই ভাষার জন্য ৬,০৫০টির বেশি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
ইতালির নাগরিক ফ্যাব্রিসিও ব্রেচ্চিয়ারোলি-র ইনারি সাami ভাষা শেখার গল্পটিও বেশ অনুপ্রেরণাদায়ক। তিনি প্রথমে প্রকৌশল নিয়ে পড়াশোনা করতে ফিনল্যান্ডে এসেছিলেন, কিন্তু পরে এই ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং এর পুনরুজ্জীবন আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
বর্তমানে তিনি ইনারি সাami ভাষার একমাত্র দৈনিক পত্রিকা ‘আনারাশ আavis’-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ভাষা রক্ষার এই লড়াইয়ে বাংলাদেশের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা রয়েছে, যা বিলুপ্তির পথে।
তাই, ইনারি সাami ভাষার পুনরুজ্জীবনের এই সংগ্রাম আমাদের দেশের ভাষাপ্রেমীদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে। ভাষার প্রতি ভালোবাসা, সঠিক পরিকল্পনা এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আমরাও আমাদের ভাষার ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে পারি।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক