এল সালভাদরের কুখ্যাত কারাগারে আটক ভেনেজুয়েলার নাগরিকদের মুক্তি চেয়ে তাঁদের পরিবার পরিজনদের অভিযোগ জানানোর সুযোগ দিচ্ছে দেশটির সরকার। তবে মানবাধিকার সংস্থা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেশটির কারাগারগুলোতে বন্দীদের প্রতি অমানবিক আচরণের অভিযোগ ওঠায়, এই প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জানা গেছে, এল সালভাদরের মানবাধিকার ও মতপ্রকাশ স্বাধীনতা কমিশনের প্রধান আন্দ্রেস গুজম্যান সিএনএনকে জানিয়েছেন, কারাগারে “অন্যায়ভাবে” আটক স্বজনদের মুক্তি চেয়ে ভুক্তভোগীরা কমিশনের দ্বারস্থ হতে পারবেন। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা ভেনেজুয়েলার নাগরিকদের পরিবারের সদস্যরা তাঁদের স্বজনদের খবর জানার জন্য উদ্বেগের সঙ্গে অপেক্ষা করছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহে ২৩৮ জন ভেনেজুয়েলার নাগরিককে এল সালভাদরে ফেরত পাঠান। তাঁদের বিরুদ্ধে ভেনেজুয়েলার একটি গ্যাং, ‘ট্রেন দে আরাগুয়া’র সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। বিতাড়িত এই ব্যক্তিদের দেশটির কুখ্যাত ‘সেন্টার ফর টেররিজম কনফাইনমেন্ট’ বা সেকোট কারাগারে রাখা হয়েছে, যা আমেরিকার বৃহত্তম কারাগার হিসেবে পরিচিত।
পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের স্বজনদের শনাক্ত করতে পেরেছেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ভেনেজুয়েলার সরকার ও পরিবারের সদস্যরা এল সালভাদরে তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে হওয়া আচরণের তীব্র নিন্দা করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, বিতাড়িত ব্যক্তিদের গ্যাং সদস্য প্রমাণে কোনো প্রমাণ পেশ করতে পারেনি এল সালভাদর কিংবা যুক্তরাষ্ট্র।
প্রায় ৪০ হাজার বন্দী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন সেকোট কারাগার নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্দীদের প্রতি অমানবিক আচরণের অভিযোগ করে আসছে। এমনকি, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরও ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা “নির্যাতন বা নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অবমাননাকর আচরণ অথবা শাস্তির” বিষয়টি স্বীকার করেছে। একই সঙ্গে, কারাগারে “কঠিন এবং জীবন-হুমকি সৃষ্টিকারী পরিবেশ” এবং দেশটির আইন প্রয়োগকারী সংস্থার “স্বেচ্ছাধীন গ্রেপ্তার বা আটক”-এর বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে।
বর্তমানে কারাগারে ১০ থেকে ২০ হাজার বন্দীকে রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন যে ২৬১ জনকে ফেরত পাঠিয়েছে, তাঁরাও এই কারাগারে রয়েছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা এল সালভাদর— কেউই এখন পর্যন্ত বিতাড়িত ভেনেজুয়েলার নাগরিকদের পরিচয় নিশ্চিত করেনি।
এল সালভাদরের প্রেসিডেন্ট নাজিব বুকেলে জানিয়েছেন, আটককৃতদের এক বছর অথবা তার বেশি সময় ধরে কারাগারে থাকতে হতে পারে। যদিও গুজমানের দপ্তর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে না, তবে তাদের কাছে আসা অভিযোগগুলো তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। তবে বন্দীদের স্বজন এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গুজমানের দপ্তর এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারবে না।
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও জননীতি বিভাগের অধ্যাপক গুস্তাভো ফ্লোরেস-মাসিয়াস মনে করেন, কমিশন থেকে পাওয়া সুযোগের ফল পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাঁর মতে, বুকেলে নিযুক্ত গুজমানের মূল আগ্রহ হলো সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষা করা, আটককৃত ও তাঁদের পরিবারের প্রতি সমর্থন জানানো নয়।
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে, এল সালভাদর ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি বিতর্কিত চুক্তির কথাও শোনা যাচ্ছে। বুকেলে, যুক্তরাষ্ট্রের বিতাড়িত বন্দীদের কারাগারে রাখার প্রস্তাব দেন এবং এর বিনিময়ে ৬ মিলিয়ন ডলার চেয়েছিলেন। এই অর্থ এল সালভাদরের কারাগার ব্যবস্থাপনার জন্য খরচ করার কথা ছিল, যেখানে বছরে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়।
ভেনেজুয়েলার সরকার তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার জন্য জোরালো আহ্বান জানাচ্ছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো বুকেলেকে ভেনেজুয়েলার নাগরিকদের ফেরত দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। মাদুরো কিংবা সিএনএনের পক্ষ থেকে বুকেলের কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে, ভেনেজুয়েলার শান্তি আলোচনা বিষয়ক বিশেষ দূত হোর্হে রদ্রিগেজ গোমেজ জানান, যুক্তরাষ্ট্রে আটক ভেনেজুয়েলার নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে, রবিবার তাঁদের প্রত্যাবাসন ফ্লাইট চালুর কথা ছিল।
রদ্রিগেজ বলেন, “বিদেশ গমন কোনো অপরাধ নয়। আমরা তাঁদের ফিরিয়ে আনতে বিশ্রাম নেব না, যাঁরা মুক্তি চান এবং এল সালভাদরে অপহৃত আমাদের ভাইদের উদ্ধার করব।”
এল সালভাদর সরকার বলছে, বিতাড়িত বন্দীদের অধিকারকে সম্মান জানানো হচ্ছে এবং বিদেশি বন্দীদের সঙ্গে স্থানীয় বন্দীদের মতো একই আচরণ করা হচ্ছে। গুজম্যান জানান, “অন্য দেশ থেকে আসা বন্দীদের ক্ষেত্রে, এল সালভাদরের কারাগার ব্যবস্থার অন্য যে কোনো বন্দীর মতোই একই রকম আচরণ করা হয়।”
তবে, সরকারের এমন বক্তব্যে জনগণের অসন্তোষ কমেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। মঙ্গলবার, কারাকাসে ভেনেজুয়েলার কিছু নাগরিক বিক্ষোভ করেন। তাঁদের দাবি, তাঁরা তাঁদের স্বজনদের চিহ্নিত করতে পেরেছেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে অবিলম্বে তাঁদের ফেরত পাঠানোর দাবি জানান।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সূত্রে জানা যায়।