নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী: আমেরিকার সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল বিজ্ঞান, আজ সেই বিজ্ঞানই গভীর সংকটে
যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে আসা একজন তরুণ, যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন উন্নত জীবনের। কঠিন পরিস্থিতি থেকে আমেরিকায় এসে সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা ও গবেষণার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানী হিসেবে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
তিনি আর কেউ নন, ২০১৮ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল জয়ী ড. আর্ডেম পাটাপৌতিয়ান। সম্প্রতি তিনি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে জানিয়েছেন, গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্দ কমানোর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান এখন গভীর সংকটের মধ্যে পড়েছে।
এর ফলে কেবল আমেরিকার নয়, বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং অর্থনীতির ওপরও মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।
লেবাননের গৃহযুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা আর্ডেম পাটাপৌতিয়ান যুক্তরাষ্ট্রে এসে উন্নত জীবনের সন্ধান পান। সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে বিজ্ঞান গবেষণার সুযোগ তাকে আকৃষ্ট করে।
সরকারের পক্ষ থেকে পাওয়া আর্থিক সহায়তা, যেমন – ফেল গ্রান্ট, তাকে উচ্চশিক্ষায় সহায়তা করেছে। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি বায়োমেডিকেল সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তীতে খ্যাতিমান গবেষক হিসেবে পরিচিত হন।
ড. পাটাপৌতিয়ান মনে করেন, আমেরিকার বিজ্ঞানচর্চার এই অগ্রযাত্রা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কঠোর পরিশ্রম ও জাতীয় বিনিয়োগের ফল। কিন্তু বর্তমানে, এই গুরুত্বপূর্ণ খাতে অর্থ বরাদ্দ কমানোর কারণে দেশটির বিজ্ঞান জগৎ এক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
গবেষণা খাতে অনুদান হ্রাস এবং অত্যাবশ্যকীয় সুযোগ-সুবিধার অভাবে যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা বিজ্ঞান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলস্বরূপ, চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরবর্তী প্রজন্মের উদ্ভাবনগুলো বাধাগ্রস্ত হবে এবং বিশ্বব্যাপী আমেরিকার যে নেতৃত্ব, সেটিও দুর্বল হয়ে পড়বে।
আর্ডেম পাটাপৌতিয়ানের গবেষণার জন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ (এনআইএইচ)-এর অনুদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অনুদানের মাধ্যমেই তিনি তাপমাত্রা ও স্পর্শের অনুভূতি নির্ণয় করার জন্য শরীরের সংবেদী অঙ্গের গঠন আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এই আবিষ্কারের ফলে মানুষ কীভাবে উষ্ণতা অনুভব করে, প্রিয়জনের স্পর্শে কেমন অনুভূতি হয়, তা আরও ভালোভাবে বোঝা যায়। এই গবেষণা শুধু কৌতূহল মেটানোর জন্য শুরু হলেও, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।
এটি ব্যথা, হৃদরোগসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে, প্রয়োজনীয় অর্থায়নের অভাবে তার গবেষণার অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে।
গবেষণায় অর্থায়ন কমানোর এই সিদ্ধান্তের ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বড় ধরনের ক্ষতি হবে। বর্তমানে জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন ক্যান্সার থেরাপি, যেমন – কিউট্রুডা ও সিসপ্ল্যাটিন অথবা রোগ নির্ণয়ের জন্য এমআরআই স্ক্যানিং, সবই ফেডারেল অর্থায়নের ফল।
বিজ্ঞান গবেষণায় সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমেই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে এবং কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞান নয়, লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি এবং ওজন স্তর রক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনের পেছনেও মৌলিক গবেষণার অবদান রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান গবেষণা খাতে এনআইএইচ-এর বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সুবিধা তৈরি করে। এক ডলার বিনিয়োগ করলে স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রায় ২.৫৬ ডলার বৃদ্ধি হয়।
এনআইএইচ-এর অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণাগুলো সারা দেশে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং প্রতি বছর প্রায় ৯৫ বিলিয়ন ডলার অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখে।
বর্তমানে, চীনসহ অন্যান্য দেশগুলো আমেরিকার এই সাফল্যের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে এবং তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করছে। এমতাবস্থায়, গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্দ কমানোর সিদ্ধান্ত আমেরিকার জন্য আত্মঘাতী হতে পারে।
ড. পাটাপৌতিয়ান মনে করেন, বিজ্ঞান গবেষণায় অর্থ বিনিয়োগ না করা হলে তা ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর হবে এবং এর ফলে উদ্ভাবন ও উন্নয়নে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে আমেরিকার ক্ষমতা হ্রাস পাবে।
ড. পাটাপৌতিয়ান আরও বলেন, তিনি ইতোমধ্যে চীন থেকে তার গবেষণাগার সেখানে স্থানান্তরের প্রস্তাব পেয়েছেন, যেখানে ২০ বছর ধরে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। যদিও তিনি এখনই যুক্তরাষ্ট্র ছাড়ার পরিকল্পনা করছেন না, তবে এমন প্রস্তাব আসাই উদ্বেগের বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিস্থিতি বিশ্ব বিজ্ঞান ও অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত। উন্নত ভবিষ্যতের জন্য বিজ্ঞান গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়া এবং এর প্রতি সমর্থন জানানো অত্যন্ত জরুরি।
তথ্য সূত্র: সিএনএন