যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র আর বিস্ফোরক বোঝাই ড্রোন— কয়েক দিনের তীব্র সংঘাতের পর অবশেষে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। উভয় প্রতিবেশী দেশের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলা এই সংঘর্ষের অবসান কিভাবে হলো, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে চলছে আলোচনা।
সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, কয়েকদিন ধরে চলা উত্তেজনা প্রশমনে উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনার মূল চাবিকাঠি ছিল ফোন এবং কূটনৈতিক তৎপরতা। তবে ভারত ও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ঘটনার কিছু বিবরণ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। আলোচনার সূত্রপাত হয় শনিবার দুপুরে।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা তার ভারতীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে ‘হটলাইন’ বার্তায় যোগাযোগ করেন। এরপরই মূলত যুদ্ধবিরতির প্রক্রিয়া শুরু হয়।
সামরিক কর্মকর্তাদের আলোচনার মাঝে, ভারতের সামরিক অভিযান বিভাগের মহাপরিচালক জানান, শনিবার সকালে পাকিস্তানের হামলার জবাব নিয়ে যখন আলোচনা চলছিল, তখন তিনি তার পাকিস্তানি সহকর্মীর কাছ থেকে যোগাযোগের প্রস্তাব পান। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল।
তবে তারা কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেনি। পাকিস্তানের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি কার্যকরে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
ভারতীয় সময় বিকাল ৩টা ৩৫ মিনিটে উভয়পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাজীব ঘাই জানান, এই চুক্তির দীর্ঘমেয়াদি ফল নিয়ে আলোচনার জন্য পরবর্তীতে আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। যদিও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত বৈঠকের বিষয়ে কোনো নিশ্চিত খবর পাওয়া যায়নি।
তবে কূটনৈতিক তৎপরতায় জড়িত এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে ভারত যুদ্ধবিরতি মেনে চলবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা করেন। এরপরই ইসলামাবাদের সঙ্গে নয়াদিল্লির সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে যে চুক্তি হয়েছে, তার স্পষ্ট চিত্র উঠে আসে।
ট্রাম্প তার ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ দেওয়া এক পোস্টে জানান, যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধ করতে পেরেছে। তিনি উভয় দেশের নেতাদের ‘সাধারণ জ্ঞান’ এবং ‘বুদ্ধিমত্তার’ প্রশংসা করেন। যদিও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার প্রশংসা করা হলেও, ভারত এটিকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে রাজি নয়।
তারা চাইছে, এই যুদ্ধবিরতিকে নিজেদের জয় হিসেবে তুলে ধরতে এবং জানাতে যে, দুই দেশ সরাসরি আলোচনার মাধ্যমেই এই শান্তি চুক্তিতে পৌঁছেছে।
যুদ্ধ শুরুর আগে, ভারতীয় পক্ষ থেকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু ভারত সরকারের সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয় এবং এর ফলস্বরূপ, প্রতিশোধ নেওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে জানায়, তারা ভারতের সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে, যা ছিল তাদের ‘চোখের বদলে চোখ’ নীতি।
উভয়পক্ষের আক্রমণাত্মক পদক্ষেপের কারণে যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং সৌদি আরবের মতো দেশগুলো দ্রুত পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানান, তিনি এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন।
চীনও এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ভারত ও পাকিস্তানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং যুদ্ধবিরতির প্রতি সমর্থন জানান।
শনিবার ভারতীয় সময় বিকেল ৫টার কিছু আগে ট্রাম্প তার পোস্টে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। এর কিছুক্ষণ পরেই উভয় পক্ষই তা নিশ্চিত করে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমেই হয়েছে। তবে পাকিস্তানের কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের প্রশংসা করেন।
পাকিস্তানের এক সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ করে রুবিও’র ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই চুক্তি হয়েছে। যখন দুই পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার অভাব ছিল এবং ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চলছিল, তখন এই চুক্তি একটি বড় বিষয় ছিল।
ঐতিহাসিকভাবে, ভারত আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং তারা আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। অন্যদিকে, পাকিস্তান বিদেশি সাহায্যের উপর নির্ভরশীল।
তাই তারা সাধারণত মধ্যস্থতাকে স্বাগত জানায়। এই যুদ্ধবিরতি উভয় দেশের জন্যই স্বস্তিদায়ক হয়েছে। তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
তথ্য সূত্র: সিএনএন